ফ্রোজেন শোল্ডার বা আঠালো ক্যাপসুলাইটিস হলো কাঁধের এমন এক সমস্যা, যেখানে কাঁধের জয়েন্টের আশেপাশের টিস্যু শক্ত ও আঠালো হয়ে যায়, ফলে নড়াচড়া সীমিত হয় এবং ব্যথা বাড়ে। এই সমস্যা ধীরে ধীরে শুরু হয় এবং পর্যায়ে পর্যায়ে বাড়ে—প্রথমে ব্যথা, পরে শক্ত হয়ে যাওয়া, এরপর ধীরে ধীরে উন্নতির ধাপ। সময়মতো সঠিক যত্ন, ফিজিওথেরাপি ও ধৈর্যই এই সমস্যার প্রধান সমাধান।
ফ্রোজেন শোল্ডার কী?
ফ্রোজেন শোল্ডারে কাঁধের ক্যাপসুলে প্রদাহ ও টান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে, ফলে জয়েন্টের “স্পেস” কমে যায় এবং হাত তোলা, পিছনে নেওয়া বা ঘোরানো ক্রমে কঠিন হয়ে পড়ে। সাধারণত ৩টি ধাপ থাকে:
- ফ্রিজিং ফেজ (ব্যথা বাড়ার ধাপ): নড়াচড়া করলে তীব্র ব্যথা, রাতের দিকে ব্যথা বেশি।
- ফ্রোজেন ফেজ (শক্ত হয়ে থাকার ধাপ): ব্যথা কিছু কমে, কিন্তু নড়াচড়া খুব সীমিত।
- থুইং ফেজ (গলে যাওয়ার ধাপ): ধীরে ধীরে নড়াচড়া ফিরতে শুরু করে।
ফ্রোজেন শোল্ডার কেন হয়?
- ডায়াবেটিস: রক্তে শর্করা অনিয়ন্ত্রিত হলে ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়ে।
- চোট বা আঘাত: আঘাতের পর কাঁধ দীর্ঘদিন না নড়ালে ক্যাপসুল শক্ত হয়ে যেতে পারে।
- অপারেশনের পর: হার্ট, ব্রেস্ট বা ঘাড়/কাঁধের অপারেশনের পর কাঁধ ব্যবহার কম হলে সমস্যা দেখা দেয়।
- হরমোনাল পরিবর্তন: বিশেষ করে ৪০ বছরের পর মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়।
- দীর্ঘ সময় একই ভঙ্গিতে থাকা: অফিসে কম্পিউটারের সামনে স্থির ভঙ্গিতে কাজ, মোবাইলে ঝুঁকে থাকা, কাঁধ ব্যবহার কম করা।
প্রধান লক্ষণ
- ধীরে ধীরে কাঁধে গাঢ় ব্যথা শুরু হয়, রাতে বেশি।
- হাত মাথার উপর তোলা, পিঠের দিকে নেওয়া বা জিপ/ব্লাউজের হুক লাগানো কঠিন হয়ে পড়ে।
- কাঁধ শক্ত হয়ে যায়, রেঞ্জ অব মোশন (ROM) কমে যায়।
- কখনও ব্যথা ঘাড় বা বাহু পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।
চিকিৎসা ও সমাধান:
হিট থেরাপি ও কোল্ড থেরাপি
- ব্যথা খুব বেশি হলে প্রথমে কোল্ড প্যাক ১০–১৫ মিনিট করে দিন, দিনে ২–৩ বার।
- স্টিফনেস বেশি থাকলে হিটিং প্যাড/গরম সেঁক ১৫ মিনিট দিন; এরপর সঙ্গে সঙ্গে স্ট্রেচিং করলে উপকার বেশি।
ওষুধ
- চিকিৎসকের পরামর্শে স্বল্পমেয়াদি ব্যথানাশক/অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ব্যবহার করা যায়।
- ডায়াবেটিস বা গ্যাস্ট্রিক/কিডনি/হার্টের সমস্যায় ওষুধ বাছাইয়ে সতর্কতা জরুরি।
কর্টিকোস্টেরয়েড ইনজেকশন
- ক্যাপসুলে প্রদাহ বেশি থাকলে ডাক্তার কাঁধে স্টেরয়েড ইনজেকশন দিতে পারেন।
- এতে ব্যথা কমে, ফলে ফিজিওথেরাপির ব্যায়াম করা সহজ হয়।
ফিজিওথেরাপি: চিকিৎসার ভিত্তি
প্রথমে ব্যথা ও স্টিফনেস কমানো, এরপর রেঞ্জ ফিরিয়ে এনে শক্তি বাড়ানো—এই ক্রমে এগোয়। নিচে বাড়িতে করার নিরাপদ স্ট্রেচ ও মোবিলিটি ব্যায়াম দেওয়া হলো (ব্যথা-সহনীয় রেঞ্জে, প্রতিদিন ১–২ বার):
পেনডুলাম এক্সারসাইজ (শুরুর জন্য)
- সামনের দিকে হালকা ঝুঁকে ব্যথার হাতটি ঢিলে রেখে ছোট বৃত্তে দোলান (ঘড়ির কাঁটার দিকে/উল্টো দিকে), ২০–৩০ সেকেন্ড করে ২–৩ রাউন্ড।
- লাভ: জয়েন্টে জমাট কমে, ব্যথা না বাড়িয়ে নড়াচড়া ফিরে আসে।
টাওয়েল/দুপাট্টা দিয়ে প্যাসিভ এক্সটারনাল রোটেশন
- দু’হাতে টাওয়েল ধরে পিঠের পেছনে রাখুন; সুস্থ হাত দিয়ে ধীরে ধীরে ব্যথার হাতকে বাইরের দিকে ঘোরান।
- ১০–১২ বার, প্রতিটি ৫–৮ সেকেন্ড ধরে।
ওয়াল ক্লাইম্ব (ফরওয়ার্ড ফ্লেক্সন)
- দেওয়ালে আঙুল “হেঁটে” হাত যতটা সম্ভব ওপরে তুলুন; ৫–১০ সেকেন্ড ধরে রাখুন, ধীরে নামান।
- ৮–১০ বার।
ক্রস-বডি স্ট্রেচ
- সুস্থ হাত দিয়ে ব্যথার হাতকে বুকে আড়াআড়ি টেনে আনুন, কাঁধে টান লাগবে।
- ১৫–২০ সেকেন্ড ধরে, ৩–৫ বার।
স্লিপার স্ট্রেচ (ইন্টারনাল রোটেশন)
- পাশ ফিরে শুয়ে ব্যথার হাতের কনুই ৯০° ভাঁজ করে, কব্জি ধীরে নিচে চাপুন।
- ১৫ সেকেন্ড ধরে, ৫ বার (ব্যথা বেড়ে গেলে থামুন)।
শোল্ডার ব্লেড সেটিং/স্ক্যাপুলার রিট্র্যাকশন
- বুক সোজা, কাঁধ সামান্য পেছনে–নিচে টানুন; ৫ সেকেন্ড ধরে ১০–১২ বার।
- লাভ: ভঙ্গি ভালো হয়, কাঁধের মেকানিক্স ঠিক হয়।
নোট: প্রতিটি স্ট্রেচ “মৃদু টান” পর্যায়ে থামুন, তীব্র ব্যথা নয়। ব্যথা বাড়লে বরফ দিন, ২৪–৪৮ ঘণ্টা বিশ্রাম দিয়ে পুনরায় কম মাত্রায় শুরু করুন।
ম্যানুয়াল থেরাপি/মোবিলাইজেশন
- প্রশিক্ষিত ফিজিওথেরাপিস্ট গ্রেডেড জয়েন্ট মোবিলাইজেশন করে জয়েন্ট ক্যাপসুল ঢিলে করেন—এতে ROM দ্রুত ফেরে।
- সাধারণত সপ্তাহে ২–৩ সেশন, ৪–৮ সপ্তাহ।
হাইড্রোডাইলেটেশন (ক্যাপসুলার ডিস্টেনশন)
- ইমেজিং-গাইডে ক্যাপসুলে স্যালাইন/স্টেরয়েড দিয়ে “স্পেস” বাড়ানো হয়; অনেক ক্ষেত্রে ROM উন্নত হয়।
অপারেশন (শুধু নির্বাচিত কেসে)
- অ্যানেস্থেশিয়ার অধীনে ম্যানিপুলেশন (MUA) বা আর্থ্রোস্কোপিক ক্যাপসুলার রিলিজ—যখন ৩–৬ মাসের সঠিক কনজারভেটিভ চিকিৎসাতেও উন্নতি সীমিত।
- অপারেশনের পর দ্রুত ফিজিওথেরাপি জরুরি, না হলে আবার শক্ত হয়ে যেতে পারে।
দৈনন্দিন জীবন ও ভঙ্গির নির্দেশনা
- বসা/কাজ: কীবোর্ড/মাউস কাছে রাখুন, কনুই শরীরের কাছাকাছি ৯০°–তে, কাঁধ ঝুলিয়ে রাখুন, ঘাড় সোজা।
- ঘুম: পাশ ফিরে শুলে ব্যথার হাতের নিচে বালিশ; চিত হয়ে শুলে কনুইয়ের নিচে বালিশ দিয়ে হাতকে শরীর থেকে সামান্য দূরে রাখুন।
- অফিস বিরতি: প্রতি ৩০–৪০ মিনিটে ১–২ মিনিট দাঁড়ানো/হালকা স্ট্রেচ।
- ব্যাগ: এক কাঁধে ভারী ব্যাগ ঝোলানো কমান; ব্যাকপ্যাক ব্যবহার করুন।
- ডায়াবেটিস কন্ট্রোল: রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ ভালো থাকলে ফ্রোজেন শোল্ডার তাড়াতাড়ি সারে।
কবে বিশেষজ্ঞ দেখাবেন?
- রাতের ব্যথা এত বেশি যে ঘুম হয় না।
- ব্যথা–স্টিফনেস ৪–৬ সপ্তাহে কিছুই কমছে না।
- হাত ক্রমাগত দুর্বল, ঘাড়/বাহুতে ঝিনঝিন–নামা ব্যথা।
- ডায়াবেটিস/থাইরয়েড সহ-রোগ আছে এবং ব্যথা দ্রুত বাড়ছে।
৬–৮ সপ্তাহের বাস্তব পরিকল্পনা
- সপ্তাহ ১–২: হিট/কোল্ড, পেনডুলাম, ওয়াল ক্লাইম্ব, ক্রস-বডি—প্রতিদিন ১–২ বার; রাতে ব্যথা বেশি হলে বরফ/ওষুধ (চিকিৎসকের নির্দেশমতো)।
- সপ্তাহ ৩–৪: প্যাসিভ–অ্যাকটিভ রোটেশন স্ট্রেচ যোগ, স্ক্যাপুলার রিট্র্যাকশন; ফিজিও সেশন ২–৩/সপ্তাহ।
- সপ্তাহ ৫–৬: রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ডে হালকা স্ট্রেংথ (রো, এক্সটারনাল রোটেশন), ROM ধরে রাখা।
- সপ্তাহ ৭–৮: ফাংশনাল ট্রেনিং—ওভারহেড রিচ, ড্রেসিং মুভ—ধীরে ধীরে স্বাভাবিক কাজে ফেরা।
FAQ: ফ্রোজেন শোল্ডার নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন
প্রশ্ন: ফ্রোজেন শোল্ডার কি নিজে নিজে সেরে যায়?
উত্তর: অনেক ক্ষেত্রেই সময়ের সঙ্গে উন্নতি হয়, তবে সম্পূর্ণ সুস্থ হতে ৬–১৮ মাস বা তারও বেশি লাগতে পারে। নিয়মিত ফিজিও না করলে সময় দীর্ঘ হয় এবং রেঞ্জ পুরোপুরি না-ও ফিরতে পারে।
প্রশ্ন: ব্যথা থাকলে কি ব্যায়াম করব?
উত্তর: হালকা গরম সেঁকের পর “ব্যথা-সহনীয়” রেঞ্জে স্ট্রেচ করুন। তীব্র ব্যথায় জোর করবেন না। ব্যথা বেড়ে গেলে বরফ দিন, পরের দিন কম মাত্রায় পুনরায় করুন।
প্রশ্ন: ইনজেকশন কি জরুরি?
উত্তর: খুব ব্যথা ও প্রদাহে ইনজেকশন ব্যথা কমিয়ে ব্যায়াম করতে সহায়তা করে। তবে এটি ফিজিওর বিকল্প নয়—দুটো একসঙ্গে সর্বোত্তম ফল দেয়।
প্রশ্ন: অপারেশনের প্রয়োজন কতটা?
উত্তর: বেশিরভাগ রোগী অপারেশন ছাড়া সেরে ওঠেন। ৩–৬ মাস নিয়ম মেনে চিকিৎসা/ফিজিওয় উন্নতি না হলে বিশেষজ্ঞ অপশন বিবেচনা করেন।
প্রশ্ন: জিম/ভারোত্তোলন কবে শুরু করব?
উত্তর: ROM ও ব্যথা নিয়ন্ত্রণে এলে হালকা রেজিস্ট্যান্স ব্যান্ডে শুরু; ভারোত্তোলন ফেরার আগে ফিজিওথেরাপিস্টের মূল্যায়ন নিন।
প্রশ্ন: ডায়াবেটিসে কেন বেশি হয়?
উত্তর: উচ্চ শর্করা টিস্যুর কোলাজেনে “গ্লাইকেশন” বাড়ায়—ক্যাপসুল শক্ত হয়। তাই রক্তে শর্করা নিয়ন্ত্রণ চিকিৎসার বড় অংশ।
প্রশ্ন: ঘরোয়া তেল মালিশ/হিট প্যাক কাজে দেয়?
উত্তর: হালকা গরম তেল/হিট স্টিফনেস কমাতে সহায়ক—এরপর স্ট্রেচ করলে লাভ বেশি। তবে জোরে মালিশে ব্যথা বাড়লে বন্ধ করুন।