স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ আবারও নজির গড়েছে। টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে রাজ্যের নিজস্ব উদ্ভাবনী মডেল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। রাজ্য সরকারের উদ্যোগে তৈরি এই স্বাস্থ্যপরিকল্পনা এখন বিশ্বের কাছে অনুসরণযোগ্য একটি মানদণ্ড। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ঘোষণা করেছেন—বাংলার মডেল বিশ্বমঞ্চে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস চিকিৎসায় পশ্চিমবঙ্গের উদ্ভাবনী মডেল এখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড
সম্প্রতি হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক এবং অ-সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. জিন বুকম্যান কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে এসে এই পরিকল্পনার কার্যকারিতা বিস্তারিত পর্যালোচনা করেন। তিনি মডেলটির বাস্তব প্রয়োগ দেখে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হন এবং জানান, এটি ভারতের প্রথম রাজ্য-চালিত টাইপ-১ ডায়াবেটিস প্রতিরোধ কর্মসূচি, যা অন্য দেশেও একটি মানদণ্ড হিসেবে গ্রহণযোগ্য।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস মোকাবিলায় কেন এমন একটি মডেল প্রয়োজন ছিল?
টাইপ-১ ডায়াবেটিস একটি অটোইমিউন রোগ, যেখানে শিশু বা কিশোরদের শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। চিকিৎসা না পেলে বা ইনসুলিনের সঠিক সরবরাহ না থাকলে জটিলতা দ্রুত বাড়ে।
ভারতের বহু পরিবার এখনো ইনসুলিন, মনিটরিং স্ট্রিপ, গ্লুকোমিটার কিংবা নিয়মিত চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারে না। বিশেষত শিশুদের ক্ষেত্রে যত্ন, মনিটরিং এবং শিক্ষার অভাব মারাত্মক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে।
এই বাস্তব প্রয়োজন থেকেই পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটি সমন্বিত, সুসংগঠিত ও সর্বজনগ্রাহ্য T1D মডেল তৈরি করে।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ৭টি খাবার সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলা উচিত
‘বাংলার মডেল’ কীভাবে কাজ করে?
১. প্রতিটি জেলায় ডেডিকেটেড টাইপ-১ ডায়াবেটিস ক্লিনিক
রাজ্যের প্রতিটি জেলা হাসপাতালে নির্দিষ্ট দিনে T1D ক্লিনিকের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এখানে শিশুরা ইনসুলিন গ্রহণ থেকে শুরু করে গ্লুকোজ মনিটরিং, খাদ্যাভ্যাস, ব্যায়াম—সব বিষয়ে বিশেষজ্ঞ নির্দেশনা পায়।
২. স্বাস্থ্যকর্মী ও চিকিৎসকদের বিশেষ প্রশিক্ষণ
ডাক্তার, নার্স, কাউন্সেলর ও স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য পৃথক প্রশিক্ষণ মডিউল তৈরি হয়েছে।
ইনসুলিন ইনজেকশনের পদ্ধতি, গ্লুকোজ চেক, ডায়েট প্ল্যান এবং হাইপো বা হাইপার গ্লাইসেমিয়ার ঝুঁকি—সব বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
৩. বিনামূল্যে ইনসুলিন ও প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সরবরাহ
রোগীদের দেওয়া হচ্ছে—
- ইনসুলিন
- গ্লুকোমিটার
- স্ট্রিপ
- প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পরামর্শ
শিশুদের নিয়মিত ফলো-আপের জন্য একটি সুসংগঠিত নেটওয়ার্ক তৈরি হয়েছে।
৪. ইলেকট্রনিক রেজিস্ট্রি ও ডাটা মনিটরিং
রাজ্যের প্রতিটি রোগীর জন্য তৈরি হচ্ছে ডিজিটাল রেজিস্ট্রি।
এই রেজিস্ট্রির ভিত্তিতে—
- রোগীর চিকিৎসা ইতিহাস
- ইনসুলিন প্রয়োজন
- ঝুঁকি বিশ্লেষণ
- ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
সবকিছু পর্যালোচনার মাধ্যমে আরও কার্যকর পরিষেবা তৈরি হচ্ছে।
আন্তর্জাতিক প্রশংসা পশ্চিমবঙ্গকে যে উচ্চতায় পৌঁছে দিল
হার্ভার্ড মেডিক্যাল স্কুলের ড. জিন বুকম্যান এই মডেল সরেজমিনে পর্যবেক্ষণ করে উল্লেখ করেন—এটি শুধু ভারতের নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও একটি শিক্ষণীয় উদ্যোগ।
তিনি প্রশংসা করেন যে—
- বাংলার মডেল বাস্তবিকই কার্যকর এবং মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে।
- স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রশিক্ষণ অত্যন্ত সুসংগঠিত।
- শিশুদের ইনসুলিন সরবরাহ পুরোপুরি বিনামূল্যে নিশ্চিত করা হয়েছে।
এটি রাজ্যের জন্য যেমন সম্মানজনক, তেমনি ভারতের স্বাস্থ্য ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
আরও পড়ুন: ডায়াবেটিসে মিষ্টি খাওয়া নিয়ে আর চিন্তা নয়: ৩টি সহজ ও নিরাপদ রেসিপি
এই প্রকল্প ইতিমধ্যে যে ফল দিয়েছে
- ২০২২ সাল থেকে পাইলট প্রকল্প হিসেবে কয়েকটি জেলায় শুরু হলেও এখন তা বিস্তৃত হয়েছে।
- বহু শিশু নিয়মিত ইনসুলিন ও ফলো-আপ পাচ্ছে, ফলে জটিলতা কমছে।
- পরিবারগুলো রোগ সম্পর্কে আরও সচেতন হচ্ছে।
- সরকারি ব্যবস্থায় দীর্ঘমেয়াদী একটি শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে উঠছে।
আগামী দিনের লক্ষ্য—কোথায় নজর দেওয়া উচিত
১. উত্তরবঙ্গ ও দূরবর্তী গ্রামীণ এলাকায় পরিষেবা আরও শক্তিশালী করা।
২. স্কুল-পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করা।
৩. রোগীদের মানসিক ও সামাজিক সাপোর্ট সিস্টেম গড়ে তোলা।
৪. ডাটার ভিত্তিতে নিয়মিত গবেষণা ও নতুন কৌশল উদ্ভাবন।
এই মডেলকে আরও কার্যকর করতে হলে স্থানীয় মানুষের অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে।
টাইপ-১ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা:
টাইপ-১ ডায়াবেটিস আজীবন নিয়ন্ত্রণে রাখতে যা অবশ্যই মনে রাখতে হবে—
১. ইনসুলিন সময়মতো গ্রহণ
কোনো দিন ইনসুলিন বাদ দেবেন না।
সময় অনুযায়ী নেওয়া সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
২. গ্লুকোজ মনিটরিং
সপ্তাহে নির্দিষ্ট সংখ্যক বার রক্তে গ্লুকোজ পরীক্ষা করা উচিত।
অস্বাভাবিক ফল পেলে তৎক্ষণাৎ চিকিৎসকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে।
৩. খাবারে নিয়ম মেনে চলা
কার্বোহাইড্রেট নিয়ন্ত্রণ, সঠিক পরিমাপ, পরিমিত ফ্যাট, প্রচুর সবজি ও জল—এগুলো বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ।
৪. শারীরিক পরিশ্রম
প্রতিদিন অন্তত আধা ঘণ্টা ব্যায়াম শিশুর শরীরকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে।
৫. অভিভাবকের সচেতনতা
শিশুর মনোবল বাড়ানো, নিয়মিত সময়মতো খাবার ও ওষুধ দেওয়া, স্কুলকে জানানো—এসবই অত্যন্ত প্রয়োজন।
৬. জরুরি পরিস্থিতিতে করণীয় শিখিয়ে দেওয়া
হাইপো বা হাইপার গ্লাইসেমিয়া হলে কী করতে হবে, সবসময় প্রস্তুত থাকা জরুরি।
ডাক্তারের মতে, “টাইপ-১ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সম্ভব, যদি নিয়ম মেনে সঠিক সাপোর্ট সিস্টেম পাওয়া যায়। আর পশ্চিমবঙ্গের এই মডেল সেই সাপোর্টকে সহজলভ্য করেছে।”
উপসংহার
পশ্চিমবঙ্গের টাইপ-১ ডায়াবেটিস মডেল একটি বড় উদাহরণ—
যেখানে সরকারি উদ্যোগ, চিকিৎসা-বিশেষজ্ঞ, স্বাস্থ্যকর্মী এবং পরিবার—সবাই মিলেই একটি আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে।
এই উদ্যোগ প্রমাণ করেছে:
সঠিক পরিকল্পনা থাকলে প্রতি শিশুর জন্য নিরাপদ, দীর্ঘমেয়াদি ও কার্যকর ডায়াবেটিস চিকিৎসা নিশ্চিত করাই সম্ভব।

