ইবোলা ভাইরাস (EBOV) এমন একটি ভয়ঙ্কর সংক্রামক ভাইরাস, যা ইবোলা ভাইরাস ডিজিজ (EVD) নামে পরিচিত। এটি মূলত মধ্য ও পশ্চিম আফ্রিকার কিছু অংশে দেখা যায়। এই রোগটি ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার বা রক্তক্ষরণজনিত জ্বর হিসেবে পরিচিত, যা রোগীর শারীরিক দুর্বলতা, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের বিকলতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
Ebola Virus: ইবোলা ভাইরাস কী?
ইবোলা ভাইরাস Filoviridae পরিবারের সদস্য, যা Orthoebolavirus গণের অন্তর্গত। এখনও পর্যন্ত ছয় ধরনের Orthoebolavirus শনাক্ত করা হয়েছে, যার মধ্যে তিনটি বড় আকারে মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ঘটায়। ইবোলা ভাইরাস (EBOV) তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ঙ্কর এবং এর মৃত্যুহার সবচেয়ে বেশি।
Ebola সংক্রমণের উৎস :
ইবোলা ভাইরাস সংক্রমণ সাধারণত পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায়। বিশেষ করে ফলখেকো বাদুড়, শিম্পাঞ্জি এবং অন্যান্য প্রাইমেট থেকে এর সংক্রমণ ঘটতে পারে। এরপর সংক্রামিত ব্যক্তির রক্ত বা শরীর থেকে নিঃসৃত তরল (যেমন বমি, মূত্র, বীর্য) এবং দূষিত বস্তুর সংস্পর্শে এসে মানুষ থেকে মানুষে সংক্রমণ ঘটে।
আরও পড়ুন:নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ১৬টি জাদুকরী উপকারিতা
Ebola হওয়ার লক্ষণ :
ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ সাধারণত ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে প্রকাশ পায়। প্রথম দিকে সাধারণ ফ্লু-এর মতো উপসর্গ দেখা দেয়, যেমন:
- জ্বর
- মাথাব্যথা
- গলা ব্যথা
- দুর্বলতা ও পেশী ব্যথা
পরবর্তীতে রোগের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে নিম্নলিখিত লক্ষণগুলি দেখা দেয়:
- বমি ও ডায়রিয়া
- শরীরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি
- যকৃত ও কিডনির কার্যকারিতা কমে যাওয়া
- কিছু ক্ষেত্রে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ রক্তপাত
রোগের সংক্রমণ বিধি:
ইবোলা ভাইরাস সাধারণত বাতাসের মাধ্যমে ছড়ায় না। সংক্রমণ ঘটে মূলত:
- আক্রান্ত ব্যক্তি বা পশুর শরীর থেকে নির্গত তরলের সরাসরি সংস্পর্শে এলে।
- সংক্রামিত বস্তুর (যেমন—সিরিঞ্জ, বিছানা) স্পর্শের মাধ্যমেও সংক্রমণ ঘটতে পারে।
Ebola রোগ নির্ণয়:
রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে ভাইরাসের আরএনএ (RNA) বা অ্যান্টিজেন শনাক্ত করে এই রোগ নির্ণয় করা হয়। রিয়েল-টাইম পিসিআর (RT-PCR) টেস্টের মাধ্যমে দ্রুত এবং নির্ভুলভাবে রোগ শনাক্ত করা সম্ভব।
Ebola – ইবোলার ঘরোয়া প্রতিকার :
ইবোলা ভাইরাসের জন্য কোনো কার্যকরী এবং নিরাপদ ঘরোয়া প্রতিকার (home remedy) নেই।
এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা পরিষ্কারভাবে বোঝা প্রয়োজন। ইবোলা একটি মারাত্মক এবং প্রাণঘাতী রোগ, যার চিকিৎসা বাড়িতে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এই রোগে আক্রান্ত হলে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া এবং বিশেষজ্ঞ ডাক্তারি তত্ত্বাবধান প্রয়োজন।
কেন ইবোলার কোনো ঘরোয়া প্রতিকার নেই?
১. মারাত্মক প্রকৃতি: ইবোলা সাধারণ জ্বর বা সর্দি-কাশির মতো কোনো রোগ নয়। এটি একটি ভাইরাল হেমোরেজিক ফিভার, যা শরীরের রক্ত জমাট বাঁধার প্রক্রিয়াকে নষ্ট করে দেয় এবং অভ্যন্তরীণ ও বাহ্যিক রক্তক্ষরণের কারণ হতে পারে। এর ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে দ্রুত মৃত্যু ঘটতে পারে।
২. দ্রুত অবনতি: এই রোগে আক্রান্ত রোগীর শারীরিক অবস্থার খুব দ্রুত অবনতি ঘটে। তীব্র ডিহাইড্রেশন (জলশূন্যতা), ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্যহীনতা এবং রক্তচাপ কমে যাওয়ার মতো জটিলতা দেখা দেয়, যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শিরায় তরল (intravenous fluids) এবং নিবিড় পরিচর্যা (intensive care) প্রয়োজন। [, 366]
৩. উচ্চ মৃত্যুহার: ইবোলা ভাইরাসের গড় মৃত্যুহার প্রায় ৫০%, তবে কিছু প্রাদুর্ভাবে এটি ৯০% পর্যন্তও পৌঁছেছে। শুধুমাত্র সঠিক ও সময়মতো ডাক্তারি চিকিৎসাই রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে পারে।
ইবোলার আসল চিকিৎসা কী?
ইবোলার কোনো নির্দিষ্ট নিরাময়কারী ওষুধ নেই। এর চিকিৎসা মূলত সহায়ক যত্ন (Supportive Care), যা হাসপাতালে করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে:
- শরীরে তরলের জোগান: শিরায় স্যালাইন (IV fluids) বা ওরাল রিহাইড্রেশন সল্যুশন (ORS) দিয়ে ডিহাইড্রেশন রোধ করা।
- উপসর্গ নিয়ন্ত্রণ: জ্বর, ব্যথা, বমি ও ডায়রিয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ দেওয়া।
- অক্সিজেন থেরাপি: শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক রাখতে অক্সিজেন দেওয়া।
- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ: রক্তচাপ স্বাভাবিক রাখার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
সম্প্রতি, Inmazeb™ এবং Ebanga™ নামে দুটি মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি চিকিৎসাকে FDA অনুমোদন দিয়েছে, যা ইবোলার বিরুদ্ধে কার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। এগুলি অত্যন্ত বিশেষায়িত চিকিৎসা, যা শুধুমাত্র হাসপাতালেই দেওয়া সম্ভব।
চিকিৎসা ও প্রতিকার :
বর্তমানে ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনো নিরাময়কারী ওষুধ নেই। তবে রোগের উপসর্গ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়, যেমন:
- শরীরে তরলের জোগান দেওয়া (Intravenous fluids)।
- লক্ষণ অনুযায়ী ব্যথা ও জ্বর নিয়ন্ত্রণ করা।
- সংক্রমণ প্রতিরোধে বিশেষ যত্ন নেওয়া।
তবে কিছু গবেষণায় মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপির মাধ্যমে রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেড়েছে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিনও অনুমোদিত হয়েছে, তবে তা সব ধরনের ভাইরাসের জন্য কার্যকর নয়।
ঝুঁকি ও সতর্কতা :
বিভিন্ন প্রজাতির ফলখেকো বাদুড়কে এই ভাইরাসের প্রাকৃতিক বাহক বলে মনে করা হয়, তাই এমন এলাকায় বসবাসকারী মানুষদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকা উচিত। সংক্রমণ রোধে নিম্নলিখিত সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি:
- আক্রান্ত ব্যক্তির সাথে সরাসরি সংস্পর্শ এড়িয়ে চলা।
- সংক্রামিত জায়গা ও বস্তু সঠিকভাবে জীবাণুমুক্ত করা।
- স্বাস্থ্যকর্মীদের জন্য ব্যক্তিগত সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম (PPE) ব্যবহার করা।
Ebola virus history –বিশ্বব্যাপী প্রভাব:
ইবোলা ভাইরাস প্রথম ১৯৭৬ সালে আফ্রিকার একটি প্রত্যন্ত গ্রামে শনাক্ত হয়। ২০১৪-২০১৬ সালের পশ্চিম আফ্রিকার মহামারী ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছিল। বর্তমানেও ডেমোক্র্যাটিক রিপাবলিক অব কঙ্গো এবং অন্যান্য জায়গায় মাঝে মাঝে এর প্রাদুর্ভাব দেখা যায়।
FAQ (প্রশ্নোত্তর)
ইবোলা ভাইরাস কি?
এটি ফাইলোভাইরাস পরিবারভুক্ত একটি ভাইরাস, যা মারাত্মক রক্তক্ষরণজনিত রোগ ঘটায় এবং এটি মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে।
ইবোলা ভাইরাস কীভাবে ছড়ায়?
সংক্রমণ ঘটে সংক্রামিত মানুষের রক্ত বা শরীর থেকে নিঃসৃত তরল এবং সংক্রামিত বস্তুর স্পর্শের মাধ্যমে। এটি বাতাসে ছড়ায় না।
ইবোলা ভাইরাসের লক্ষণ কী কী?
প্রাথমিক লক্ষণগুলির মধ্যে রয়েছে জ্বর, মাথাব্যথা, দুর্বলতা, পেশী ব্যথা। পরবর্তীতে বমি, ডায়রিয়া এবং রক্তপাত দেখা দিতে পারে।
ইবোলা ভাইরাসের কোনো ভ্যাকসিন আছে?
হ্যাঁ, কয়েকটি দেশে ইবোলা ভাইরাসের বিরুদ্ধে ভ্যাকসিন অনুমোদিত হয়েছে, তবে তা সব ধরনের ইবোলা ভাইরাসের জন্য কার্যকর নয়। গবেষণা এখনো চলছে।
ইবোলা ভাইরাসের চিকিৎসা কী?
নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ নেই। তবে রোগীর শরীরে তরলের জোগান দেওয়া, ব্যথা নিয়ন্ত্রণ করা এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করাই প্রধান চিকিৎসা। মোনোক্লোনাল অ্যান্টিবডি থেরাপি রোগীর বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বাড়াতে সাহায্য করে।
ইবোলা ভাইরাস কতদিনের মধ্যে লক্ষণ দেখায়?
সাধারণত সংক্রমণের পর ২ থেকে ২১ দিনের মধ্যে লক্ষণ প্রকাশ পায়, তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৮ থেকে ১০ দিনের মধ্যেই দেখা যায়।
কীভাবে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন?
সংক্রামিত ব্যক্তির সাথে সরাসরি যোগাযোগ এড়িয়ে চলুন, পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন
উপসংহার
ইবোলা ভাইরাস একটি মারাত্মক এবং ঝুঁকিপূর্ণ রোগ, যার বিরুদ্ধে সতর্কতা এবং দ্রুত সঠিক চিকিৎসা অত্যন্ত জরুরি। এই ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধে সমাজের সচেতনতা এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রস্তুতি অপরিহার্য। নিরাপদ জীবনযাপনের মাধ্যমে আমরা এই ঘাতক ভাইরাস থেকে নিজেদের এবং নিজেদের পরিবারকে সুরক্ষিত রাখতে পারি।