causes-symptoms-effective-treatment-heel-pain-plantar-fasciitis

Plantar Fasciitis||গোড়ালি ব্যথার কারণ, উপসর্গ ও কার্যকর চিকিৎসা

Share This Post

প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথম কয়েক পা ফেলতে গেলেই যদি আপনার গোড়ালিতে তীব্র ছুরির মতো ব্যথা অনুভূত হয়, তবে আপনি একা নন। এই সমস্যাটি অত্যন্ত পরিচিত এবং এর নাম গোড়ালি ব্যথা। এটি সাধারণত পায়ের গোড়ালির নিচে বা পেছনের দিকে হয়ে থাকে এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ভীষণভাবে প্রভাবিত করতে পারে। এই ব্যথার সবচেয়ে সাধারণ এবং প্রধান কারণ হলো প্লান্টার ফ্যাসাইটিস (Plantar Fasciitis) । চলুন, এই অস্বস্তিকর সমস্যাটি সম্পর্কে সহজ ভাষায় বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক।


গোড়ালি ব্যথা আসলে কী?

গোড়ালি ব্যথা হলো পায়ের গোড়ালির হাড় (ক্যালকেনিয়াস) এবং এর আশেপাশের টিস্যুতে সৃষ্ট যেকোনো ধরনের ব্যথা বা অস্বস্তি। এই ব্যথার পেছনে সবচেয়ে বড় खलनायक হলো প্লান্টার ফ্যাসিয়া (Plantar Fascia) নামক একটি লিগামেন্টের প্রদাহ । এই লিগামেন্টটি আমাদের পায়ের গোড়ালির হাড় থেকে শুরু হয়ে পায়ের পাতার আঙুল পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এটি অনেকটা ধনুকের ছিলা বা ব্যান্ডের মতো কাজ করে, যা হাঁটার সময় আমাদের পায়ের আর্চ বা বাঁককে সাপোর্ট দেয় এবং শরীরের ওজন বহন করতে সাহায্য করে। যখন এই টিস্যুটির ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে বা এটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তখন এতে প্রদাহ সৃষ্টি হয় এবং তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়। একেই প্লান্টার ফ্যাসাইটিস বলা হয়।


গোড়ালি ব্যথার সাধারণ কারণগুলো কী কী?

গোড়ালি ব্যথার পেছনে একটি বা একাধিক কারণ থাকতে পারে। সবচেয়ে প্রচলিত কারণগুলো হলো:

  • প্লান্টার ফ্যাসাইটিস (Plantar Fasciitis): এটি গোড়ালি ব্যথার প্রধান কারণ। পায়ের পাতার নিচের শক্ত ব্যান্ড বা লিগামেন্টে প্রদাহ বা ছোট ছোট ক্ষত (micro-tears) তৈরি হলে এই ব্যথা হয় ।
  • হিল স্পার বা হাড়ের কাঁটা (Heel Spur): দীর্ঘ সময় ধরে প্লান্টার ফ্যাসিয়ার উপর চাপ পড়তে থাকলে শরীর নিজেকে রক্ষা করার জন্য গোড়ালির হাড়ের নিচে ক্যালসিয়াম জমা করে একটি সূঁচালো হাড়ের বৃদ্ধি ঘটায় । একেই হিল স্পার বলে, যা হাঁটার সময় খোঁচা দেওয়ার মতো ব্যথা তৈরি করে।
  • অতিরিক্ত ওজন বা স্থূলতা: শরীরের ওজন বেশি হলে পায়ের ওপর, বিশেষ করে গোড়ালির ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে। এই অতিরিক্ত চাপ প্লান্টার ফ্যাসিয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ব্যথার কারণ হতে পারে ।
  • ভুল বা অনুপযুক্ত জুতা ব্যবহার: শক্ত সোল, ফ্ল্যাট বা হাই হিলের জুতা পরলে তা পায়ের আর্চকে সঠিক সাপোর্ট দেয় না। ফলে গোড়ালিতে অস্বাভাবিক চাপ পড়ে এবং ব্যথা শুরু হয় ।
  • হঠাৎ আঘাত বা অতিরিক্ত ব্যবহার: খেলাধুলা, দৌড়ানো, বা হঠাৎ করে পা মচকে গেলে লিগামেন্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ব্যথা হতে পারে । আবার, দীর্ঘ সময় ধরে শক্ত কোনো তলের উপর দাঁড়িয়ে কাজ করা (যেমন—শিক্ষক, ট্রাফিক পুলিশ) বা অতিরিক্ত হাঁটাচলার কারণেও এই সমস্যা দেখা দেয় ।
  • অন্যান্য কারণ: অ্যাকিলিস টেন্ডিনাইটিস (গোড়ালির পেছনের টেন্ডনের প্রদাহ), বারসাইটিস (জয়েন্টের তরল থলির প্রদাহ), এবং আর্থ্রাইটিসের মতো রোগও গোড়ালি ব্যথার কারণ হতে পারে ।

প্লান্টার ফ্যাসাইটিস কেন হয়? এর পেছনের কারণগুলো

প্লান্টার ফ্যাসাইটিস নির্দিষ্ট কিছু কারণে বেশি হয়:

  • পায়ের গঠনগত সমস্যা: যাদের পায়ের তলা জন্মগতভাবে ফ্ল্যাট (Flat Feet) অথবা আর্চ বা বাঁক স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি উঁচু (High Arch), তাদের প্লান্টার ফ্যাসিয়াতে বেশি চাপ পড়ে ।
  • পেশাগত কারণ: যারা দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে বা হেঁটে কাজ করেন (যেমন—কারখানার শ্রমিক, সেলসম্যান, শিক্ষক), তাদের এই সমস্যায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি।
  • ব্যায়ামের ধরণ: হঠাৎ করে খুব বেশি দৌড়ানো, লাফানো বা কঠিন কোনো ব্যায়াম শুরু করলে পায়ের টিস্যু সেই চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে না, ফলে প্রদাহ শুরু হয়।
  • বয়স: সাধারণত ৪০ থেকে ৬০ বছর বয়সী মানুষের মধ্যে এই সমস্যা বেশি দেখা যায়, কারণ বয়সের সাথে সাথে প্লান্টার ফ্যাসিয়ার নমনীয়তা কমে আসে এবং এটি সহজে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ।

গোড়ালি ব্যথার প্রধান উপসর্গগুলো কীভাবে চিনবেন?

গোড়ালি ব্যথার লক্ষণগুলো বেশ স্পষ্ট এবং সহজে চেনা যায়:

  • সকালের তীব্র ব্যথা: এটি প্লান্টার ফ্যাসাইটিসের সবচেয়ে বড় লক্ষণ। সকালে ঘুম থেকে উঠে মাটিতে প্রথম পা ফেলার সাথে সাথেই গোড়ালিতে তীব্র, ছুরিকাঘাতের মতো ব্যথা অনুভূত হয় ।
  • বিশ্রামের পর ব্যথা: দীর্ঘ সময় বসে থাকার পর উঠে দাঁড়াতে গেলে বা হাঁটা শুরু করলে ব্যথা ফিরে আসে।
  • হাঁটার সাথে পরিবর্তন: কিছুক্ষণ হাঁটাচলা করার পর ব্যথা কিছুটা কমে আসে, কারণ টিস্যুগুলো সচল হয়। কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটলে বা দাঁড়ালে ব্যথা আবার বেড়ে যায়।
  • চাপ দিলে ব্যথা: গোড়ালির নিচের অংশে, বিশেষ করে মাঝ বরাবর আঙুল দিয়ে চাপ দিলে তীব্র ব্যথা অনুভূত হয়।

গোড়ালি ব্যথার কার্যকর চিকিৎসা পদ্ধতিগুলো কী কী?

গোড়ালি ব্যথার চিকিৎসা সাধারণত সহজ এবং ঘরোয়াভাবেই শুরু করা যায়। প্রায় ৯০% রোগী সার্জারি ছাড়াই সুস্থ হয়ে ওঠেন।

  • বিশ্রাম ও বরফের সেঁক: প্রথমত, পা-কে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দিন। ব্যথাযুক্ত স্থানে দিনে কয়েকবার ১৫-২০ মিনিটের জন্য বরফের প্যাক বা আইস প্যাক লাগান। এটি প্রদাহ এবং ফোলা কমাতে অত্যন্ত কার্যকর ।
  • স্ট্রেচিং ও ব্যায়াম: কাফ মাসল (পায়ের ডিম) এবং প্লান্টার ফ্যাসিয়ার জন্য নির্দিষ্ট কিছু স্ট্রেচিং ব্যায়াম ব্যথা কমাতে জাদুর মতো কাজ করে। তোয়ালে দিয়ে পায়ের পাতা নিজের দিকে টেনে ধরা বা দেওয়ালের দিকে ঝুঁকে কাফ মাসল স্ট্রেচ করা খুবই উপকারী।
  • সঠিক ও সাপোর্টিভ জুতা: নরম সোল, ভালো আর্চ সাপোর্ট এবং কুশনযুক্ত হিল প্যাড আছে এমন জুতা ব্যবহার করুন। খালি পায়ে বা শক্ত সোলের চপ্পল পরে হাঁটাচলা এড়িয়ে চলুন ।
  • ওষুধপত্র: চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যথানাশক (Painkiller) বা প্রদাহরোধী (Anti-inflammatory) ওষুধ, যেমন—প্যারাসিটামল বা আইবুপ্রোফেন সেবন করা যেতে পারে।
  • স্টেরয়েড ইনজেকশন: যদি ব্যথা খুব তীব্র হয় এবং সাধারণ চিকিৎসায় না কমে, তবে চিকিৎসক প্রদাহ কমানোর জন্য সরাসরি ব্যথাযুক্ত স্থানে স্টেরয়েড ইনজেকশন দিতে পারেন ।
  • সার্জারি (Surgery): এটি হলো সর্বশেষ বিকল্প। যখন অন্য কোনো চিকিৎসাতেই কাজ হয় না এবং ব্যথা ৬-১২ মাস ধরে স্থায়ী হয়, তখন খুব কম সংখ্যক রোগীর ক্ষেত্রে সার্জারির প্রয়োজন হতে পারে।

প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQ’s)

প্রশ্ন ১: গোড়ালি ব্যথা কি একটি স্থায়ী রোগ?
উত্তর: না, এটি স্থায়ী রোগ নয়। সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসা এবং জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনলে অধিকাংশ মানুষই কয়েক মাসের মধ্যে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যান।

প্রশ্ন ২: প্লান্টার ফ্যাসাইটিস হলে কি হাঁটাচলা পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া উচিত?
উত্তর: পুরোপুরি বন্ধ করার প্রয়োজন নেই। তীব্র ব্যথার সময় বিশ্রাম জরুরি, তবে ব্যথা কিছুটা কমলে হালকা হাঁটা এবং নিয়মিত স্ট্রেচিং করা পেশিকে নমনীয় রাখতে এবং রক্ত সঞ্চালন বাড়াতে সাহায্য করে।

প্রশ্ন ৩: গোড়ালি ব্যথার জন্য কোন ধরনের জুতা সবচেয়ে ভালো?
উত্তর: এমন জুতা বেছে নিন যাতে ভালো আর্চ সাপোর্ট, নরম ও আরামদায়ক সোল এবং গোড়ালির সুরক্ষার জন্য হিল কুশন বা প্যাড রয়েছে। দৌড়ানোর জন্য বিশেষভাবে ডিজাইন করা স্পোর্টস শু এক্ষেত্রে খুব উপকারী।

প্রশ্ন ৪: এই ব্যথা সাধারণত কতদিন স্থায়ী হতে পারে?
উত্তর: সঠিক চিকিৎসা ও যত্ন নিলে প্লান্টার ফ্যাসাইটিসের ব্যথা সাধারণত ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে সেরে যায়। তবে অবহেলা করলে বা চিকিৎসা না করালে এটি দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে এবং সারতে এক বছর বা তার বেশি সময়ও লাগতে পারে।

প্রশ্ন ৫: প্লান্টার ফ্যাসাইটিস কি প্রতিরোধ করা সম্ভব?
উত্তর: হ্যাঁ, অবশ্যই সম্ভব। সঠিক মাপের এবং সাপোর্টিভ জুতা পরা, শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা, ব্যায়ামের আগে ও পরে সঠিকভাবে স্ট্রেচিং করা এবং দীর্ঘ সময় ধরে শক্ত জায়গায় দাঁড়িয়ে না থাকার মাধ্যমে এটি সহজেই প্রতিরোধ করা যায়।

প্রশ্ন ৬: এই সমস্যার জন্য সার্জারি কি বাধ্যতামূলক?
উত্তর: না, একেবারেই নয়। প্রায় ৯৫% রোগীই সার্জারি ছাড়া অন্যান্য চিকিৎসায়, যেমন—বিশ্রাম, ব্যায়াম, এবং সঠিক জুতা ব্যবহারের মাধ্যমে সুস্থ হয়ে যান। সার্জারি শুধুমাত্র সেই সব চরম ক্ষেত্রে করা হয় যেখানে অন্য কোনো পদ্ধতিতেই কাজ হয় না।


উপসংহার

গোড়ালি ব্যথা, বিশেষ করে প্লান্টার ফ্যাসাইটিস, যদিও একটি যন্ত্রণাদায়ক এবং বিরক্তিকর সমস্যা, তবে এটি মোটেও আতঙ্কিত হওয়ার মতো কোনো রোগ নয়। প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলো চিনে নিয়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে খুব সহজেই এটি নিয়ন্ত্রণ এবং নিরাময় করা সম্ভব। মনে রাখবেন, আপনার পা দুটি আপনার পুরো শরীরের ভার বহন করে; তাই তাদের যত্ন নিন। স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা, সঠিক জুতা নির্বাচন, এবং নিয়মিত ব্যায়ামের মাধ্যমেই আপনি এই ব্যথাকে দূরে রাখতে পারেন এবং প্রতিটি পদক্ষেপ উপভোগ করতে পারেন।


Share This Post