পৃথিবীর প্রতিটি কোণায় এখন প্লাস্টিকের অবাধ দৌরাত্ম্য। খাবারের পাশাপাশি আমরা যে জল প্রতিদিন পান করি, তার মধ্যেও জমে আছে অগণিত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা—যাকে বলা হয় মাইক্রোপ্লাস্টিক। এগুলো এতটাই সূক্ষ্ম যে খালি চোখে ধরা পড়ে না। কিন্তু বিপদের কথা হলো, এই প্লাস্টিক কণাগুলো প্রতিদিন আমাদের শরীরে প্রবেশ করছে আর বাড়াচ্ছে ক্যানসার, কিডনির রোগ, প্রজনন সমস্যা এমনকি স্নায়ুবিক জটিলতার মতো ভয়ঙ্কর অসুখের ঝুঁকি।
গবেষকরা বলছেন, বোতলজাত জলও নিরাপদ নয়। এক লিটার বোতলজাত জলে দশ হাজারেরও বেশি প্লাস্টিক কণার অস্তিত্ব ধরা পড়েছে। এভাবে অজান্তেই প্রতিদিন শরীরে চলে যাচ্ছে হাজার হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক। তবে ঘরে বসেই খুব সহজে জল থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক দূর করার উপায় আছে।
মাইক্রোপ্লাস্টিকের উৎস ও স্বাস্থ্যঝুঁকি
কোথা থেকে জলে আসে মাইক্রোপ্লাস্টিক?
- প্লাস্টিক বোতল থেকে
- পাইপলাইনের মাধ্যমে
- পলিথিন, প্লাস্টিক পাত্র বা মগের মাধ্যমে
- শিল্প বর্জ্য জলে
- প্লাস্টিক মোড়ক খাবারের সঙ্গে জলে মেশা কণা
স্বাস্থ্যঝুঁকি
- ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়
- কিডনির রোগ সৃষ্টি করে
- শুক্রাণুর সংখ্যা কমিয়ে আনে এবং প্রজনন ক্ষমতা ক্ষতিগ্রস্ত করে
- অটিজম ও স্নায়বিক জটিলতার ঝুঁকি বাড়ায়
- ইমিউন সিস্টেম দুর্বল করে
চীনা বিজ্ঞানীদের সহজ সমাধান
চীনের গুয়াংঝৌ মেডিক্যাল ইউনিভার্সিটি এবং জিনান ইউনিভার্সিটির বিজ্ঞানীরা দীর্ঘ গবেষণার পর জানিয়েছেন—জল ফুটালেই মাইক্রোপ্লাস্টিক দূর করা সম্ভব।
কীভাবে কাজ করে?
- জল ফোটালে ক্যালসিয়াম কার্বনেট জমাট বেঁধে স্ফটিক তৈরি করে।
- এই স্ফটিকগুলো মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাকে আঁকড়ে ধরে আটকে ফেলে।
- পরে সেদ্ধ জল ছেঁকে নিলে প্রায় ৯০% মাইক্রোপ্লাস্টিক দূর হয়ে যায়।
আরও পড়ুন:ইমিউনিটি বাড়াতে নিয়মিত কোন খাবারগুলো খাবেন?
ব্যবহারের নিয়ম
- জল অন্তত ৫-৭ মিনিট ধরে ফোটাতে হবে।
- পাতলা পরিষ্কার কাপড় বা ফিল্টার দিয়ে জল ছেঁকে নিতে হবে।
- সেদ্ধ জল কাচ বা মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
- প্লাস্টিক বোতলে রাখা যাবে না, কারণ সেখান থেকেও আবার প্লাস্টিক কণা মিশে যাবে।
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূর করার অন্যান্য উপায়
পদ্ধতি | কতটা কার্যকর | বাড়িতে ব্যবহারযোগ্যতা |
---|---|---|
ফুটিয়ে ছেঁকে নেওয়া | ৮০-৯০% দূর হয় | খুব সহজ |
রিভার্স অসমোসিস (RO) ফিল্টার | প্রায় ৯৫-৯৯% দূর হয় | দামি হলেও কার্যকর |
অ্যাকটিভেটেড কার্বন ফিল্টার | আংশিক কার্যকর | সাধারণ ফিল্টারে মেলে |
সেরামিক ফিল্টার | মাঝারি কার্যকর | ব্যবহার সহজ |
মাটির কলসি বা ঘটি | প্রাকৃতিক পরিমাণে কিছুটা কার্যকর | গ্রামীণ অঞ্চলে সুবিধাজনক |
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ
- প্রতিদিন বোতলজাত জলের উপর নির্ভর না করে, বাড়ির ফিল্টারকৃত বা ফুটানো জল পান করুন।
- প্লাস্টিক বোতলে সংরক্ষিত জল পানের পরিবর্তে কাচ বা মাটির পাত্র ব্যবহার করুন।
- রান্নার জন্যও ফুটানো ও ছেঁকে নেওয়া জল ব্যবহার করলে স্বাস্থ্যঝুঁকি অনেকটাই কমে যায়।
- RO ফিল্টার ব্যবহারে নিয়মিত মেমব্রেন পরিবর্তন করতে হবে, না হলে কার্যকারিতা কমে যাবে।
আরও পড়ুন:ইমিউনিটি বাড়াতে নিয়মিত কোন খাবারগুলো খাবেন?
FAQ:
মাইক্রোপ্লাস্টিক কি খালি চোখে দেখা যায়?
না, এগুলো এতটাই ক্ষুদ্র (১ মাইক্রোমিটার পর্যন্ত ছোট) যে খালি চোখে দেখা যায় না।
শুধু ফুটালেই কি সব প্লাস্টিক কণা দূর হবে?
না, ফুটালে বেশিরভাগ কণা দূর হয় (প্রায় ৯০%)। সম্পূর্ণ অপসারণের জন্য RO ফিল্টার সবচেয়ে কার্যকর।
প্লাস্টিক বোতলের জল সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ কেন?
কারণ বোতল তৈরির প্লাস্টিক থেকেই জলে মাইক্রোপ্লাস্টিক মিশে যায়।
প্রতিদিন কীভাবে নিরাপদ জল পান করা সম্ভব?
- জল অন্তত ৫ মিনিট ফুটান
- কাপড় বা ফিল্টার দিয়ে ছেঁকে নিন
- কাচ/মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করুন
মাইক্রোপ্লাস্টিক দূষণ এখন বৈশ্বিক সংকট। তবে সহজ কিছু অভ্যাস মেনে চললেই পরিবারকে এই অদৃশ্য বিষ থেকে অনেকটাই সুরক্ষিত রাখা সম্ভব। তাই প্রতিদিনই চেষ্টা করুন ফুটানো, ছেঁকে নেওয়া এবং নিরাপদ পাত্রে সংরক্ষিত জল পান করার। আর এভাবেই ছোট একটি সচেতনতা আপনাকে ও আপনার পরিবারকে মারাত্মক রোগ থেকে রক্ষা করতে পারে।