stomach alsur

পাকস্থলীর আলসার: সম্পূর্ণ নিরাময় বনাম পুনরাবৃত্তি—কী বলছেন বিশেষজ্ঞরা?

Share This Post

পাকস্থলীর আলসার ধরা পড়লে অনেকের মনেই প্রথম যে প্রশ্নটি আসে তা হলো—“এটা কি পুরোপুরি ভালো হবে, নাকি সারাজীবন ওষুধ খেয়ে বা নিয়ম মেনে চলতে হবে?” সুখবর হলো, সঠিক কারণ নির্ণয় করে পরিকল্পিত চিকিৎসা নিলে বেশিরভাগ পাকস্থলীর আলসার ৪–৮ সপ্তাহের মধ্যেই সম্পূর্ণ সেরে যায়। তবে কিছু ঝুঁকি ও জীবনযাত্রার অভ্যাস থেকে গেলে আলসার পুনরাবৃত্তি হতে পারে। তাই এই বিষয়ে সঠিক ও সম্পূর্ণ ধারণা থাকা প্রয়োজন।


পাকস্থলীর আলসার কী এবং কেন হয়?

পাকস্থলীর আলসার বা পেপটিক আলসার হলো পেটের ভেতরের দেওয়ালে তৈরি হওয়া এক ধরনের ক্ষত, যা পাকস্থলীর অ্যাসিডের সংস্পর্শে এলে ব্যথা ও জ্বালাপোড়া করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এর প্রধান কারণ দুটি:

  1. হেলিকোব্যাক্টর পাইলোরি (Helicobacter pylori) বা H. pylori সংক্রমণ: এটি এক ধরনের ব্যাকটেরিয়া যা পাকস্থলীর মিউকোসাল লাইনিং ক্ষতিগ্রস্ত করে আলসার তৈরি করে।
  2. নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি ড্রাগস (NSAIDs)-এর দীর্ঘ ব্যবহার: Ibuprofen, naproxen, aspirin-এর মতো ব্যথানাশক ওষুধ দীর্ঘদিন ধরে খেলে পাকস্থলীর প্রতিরক্ষামূলক স্তর দুর্বল হয়ে পড়ে, ফলে আলসার হতে পারে।

এছাড়াও অতিরিক্ত মানসিক চাপ, ধূমপান, অ্যালকোহল, কিছু বিরল রোগ (যেমন Zollinger-Ellison syndrome), এবং জেনেটিক কারণও আলসার তৈরিতে প্রভাব ফেলে।


আলসার নিরাময়: একটি ৪–৮ সপ্তাহের প্রক্রিয়া

এন্ডোস্কোপি করে আলসার নিশ্চিত করার পর চিকিৎসক কারণ অনুযায়ী চিকিৎসা শুরু করেন।

  • H. pylori পজিটিভ হলে: এক বা দুটি অ্যান্টিবায়োটিকের সঙ্গে অ্যাসিড-দমনকারী ওষুধ (Proton Pump Inhibitor বা PPI) দেওয়া হয়। এই কোর্স সাধারণত ১৪ দিনের।
  • NSAID-জনিত আলসার হলে: ব্যথানাশক ওষুধ বন্ধ বা পরিবর্তন করা হয় এবং ৪–৮ সপ্তাহের জন্য PPI দেওয়া হয়।

এই চিকিৎসায় আলসার পুরোপুরি সেরে ওঠে; তবে ফলো-আপ এন্ডোস্কোপি করে হিলিং দেখে নেওয়া দরকার হতে পারে।


আলসার সেরে যাওয়ার পর কি আবার হতে পারে?

হ্যাঁ—পুনরাবৃত্তি সম্ভব। যার একবার আলসার হয়, ধরে নেওয়া যায় তার জিনগত ও পরিবেশগত ঝুঁকি দুটোই আছে। জিনগত কারণ বদলানো যায় না, কিন্তু পরিবেশগত কারণ নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

  • যদি H. pylori সংক্রমণ পুরোপুরি নির্মূল না হয়।
  • যদি NSAID আবার শুরু করা হয়।
  • ধূমপান, অ্যালকোহল, অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, রাতজাগা বা মানসিক চাপ—এগুলো থাকলে পুনরায় আলসার হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।

আজীবন নিয়ম আর ওষুধ: কখন দরকার?

সাধারণত সুস্থ আলসারে আজীবন ওষুধ লাগে না; ৪–৮ সপ্তাহের চিকিৎসাই যথেষ্ট। তবে কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে লাগতে পারে:

  • বারবার আলসার হলে বা জটিলতা (যেমন রক্তপাত) হলে।
  • NSAID বন্ধ করা সম্ভব না হলে (যেমন আর্থ্রাইটিস রোগীদের ক্ষেত্রে)।
  • আলসার হিলিং ধীরগতির হলে।
  • Zollinger-Ellison syndrome-এর মতো বিরল রোগে।

এক্ষেত্রে চিকিৎসক স্বল্পমাত্রার PPI দীর্ঘ সময় ধরে ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারেন।


আলসার পুনরাবৃত্তি রোধে কার্যকরী কৌশল

  • খাদ্যাভ্যাস: তৈলাক্ত, ভাজাভুজি, অতিরিক্ত মশলাযুক্ত খাবার কমান। সহজে হজম হয় এমন খাবার (ডাল, সবজি, মাছ) খান। দীর্ঘ সময় পেট খালি রাখবেন না।
  • পানীয়: বিশুদ্ধ জল পান করুন। কফি, কার্বনেটেড পানীয়, অ্যালকোহল পরিহার বা সীমিত করুন।
  • জীবনযাত্রা: ধূমপান বর্জন করুন (এটি হিলিং ব্যাহত করে ও পুনরাবৃত্তি বাড়ায়)। নিয়মিত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমান। রাত জাগা এড়িয়ে চলুন।
  • মানসিক চাপ: মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা হালকা শরীরচর্চায় স্ট্রেস নিয়ন্ত্রণ করুন।
  • ওষুধ: চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ব্যথানাশক ওষুধ (বিশেষ করে NSAIDs) খাবেন না। প্রয়োজন হলে Paracetamol তুলনামূলক নিরাপদ।

FAQ: পাকস্থলীর আলসার নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন

প্রশ্ন: পাকস্থলীর আলসার হলে কি তা সম্পূর্ণভাবে সেরে যায়?
উত্তর: হ্যাঁ, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ৪–৮ সপ্তাহের সঠিক চিকিৎসায় (H. pylori নির্মূল + PPI) আলসার সম্পূর্ণ নিরাময় হয়। তবে জীবনযাত্রার ঝুঁকি থাকলে পুনরায় হতে পারে।

প্রশ্ন: আলসার হলে কি আজীবন ওষুধ খেতে হয়?
উত্তর: সাধারণত নয়। বারবার হওয়া বা জটিলতা তৈরি হলে চিকিৎসক দীর্ঘমেয়াদি স্বল্পমাত্রার ওষুধের পরামর্শ দিতে পারেন।

প্রশ্ন: কী কী খাবার খেলে আলসার বাড়ে?
উত্তর: নির্দিষ্ট কোনো “নিষিদ্ধ” তালিকা নেই, তবে তৈলাক্ত, ভাজাভুজি, অতিরিক্ত মশলা, কফি, অ্যালকোহল—এসব অনেকের উপসর্গ বাড়ায়। যা খেলে অস্বস্তি হয়, তা এড়িয়ে চলুন।

প্রশ্ন: ঘরোয়া উপায়ে কি আলসার সারে?
উত্তর: ঘরোয়া উপায় (যেমন বাঁধাকপির রস, মধু, হলুদ) উপসর্গ কমাতে সাহায্য করতে পারে, কিন্তু কারণ (H. pylori/NSAID) নির্মূলের জন্য ডাক্তারি চিকিৎসা অপরিহার্য।

প্রশ্ন: আলসার ও গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা কি এক?
উত্তর: না, যদিও উপসর্গ কাছাকাছি। আলসারের ব্যথা সাধারণত নির্দিষ্ট জায়গায় (পেটের উপরিভাগ), খাওয়ার ১–৩ ঘণ্টা পর বাড়ে (duodenal ulcer), বা খালি পেটে বাড়ে (gastric ulcer); জ্বালাপোড়া বেশি হয়। এন্ডোস্কোপি ছাড়া নিশ্চিত হওয়া যায় না।

প্রশ্ন: আলসার কি ক্যানসারে পরিণত হতে পারে?
উত্তর: H. pylori-জনিত gastric ulcer থেকে ক্যানসারের ঝুঁকি সামান্য হলেও থাকে। তাই ফলো-আপ ও H. pylori নির্মূল নিশ্চিত করা জরুরি। Duodenal ulcer থেকে ক্যানসারের ঝুঁকি নেই বললেই চলে।

প্রশ্ন: এন্ডোস্কোপি কি খুব যন্ত্রণাদায়ক?
উত্তর: হালকা sedation বা অবশকারী স্প্রে ব্যবহার করে করা হয়, তাই তেমন যন্ত্রণা হয় না। এটি আলসার নিশ্চিত করা ও বায়োপসি নেওয়ার সেরা পদ্ধতি।

প্রশ্ন: আলসার হলে কি দুধ খাওয়া ভালো?
উত্তর: দুধ সাময়িক আরাম দিলেও পরে অ্যাসিড উৎপাদন বাড়াতে পারে। পরিমিত পরিমাণে খাওয়া যেতে পারে, তবে চিকিৎসার বিকল্প নয়।


শেষ কথা

পাকস্থলীর আলসার একটি নিরাময়যোগ্য রোগ। সঠিক কারণ নির্ণয়, সম্পূর্ণ কোর্স চিকিৎসা এবং স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা—এই তিনটি বিষয় নিশ্চিত করলে আলসার শুধু সারে না, পুনরায় হওয়ার ঝুঁকিও অনেক কমে যায়। সুস্থ হওয়ার পর খাদ্যাভ্যাস ও জীবনযাত্রায় সামান্য শৃঙ্খলা মেনে চললেই আজীবন ওষুধ খাওয়ার প্রয়োজন সাধারণত হয় না। কোনো সন্দেহ বা উপসর্গ দেখা দিলে গ্যাস্ট্রোএন্টারোলজিস্টের পরামর্শ নিন—অনুমান বা ঘরোয়া উপায়ের ওপর নির্ভরশীল থাকবেন না।


Share This Post