c section delivery

সিজারের পর যৌন জীবন: কবে থেকে শুরু করা নিরাপদ এবং কী কী সতর্কতা জরুরি?

Share This Post

সিজারিয়ান বা সি-সেকশন একটি বড় অপারেশন। এর পর একজন মায়ের শরীর ও মনকে সুস্থ হয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে বেশ কিছুটা সময় লাগে। সন্তান জন্মের পর দম্পতিদের মনে যে প্রশ্নগুলো সবচেয়ে বেশি আসে, তার মধ্যে অন্যতম হলো—কবে থেকে পুনরায় সহবাস শুরু করা নিরাপদ? এই সময়ে শারীরিক ও মানসিক দুই ধরনের প্রস্তুতিরই প্রয়োজন হয়। চলুন, এই সংবেদনশীল বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত ও খোলামেলা আলোচনা করা যাক।


আরও পড়ুন:সিজারের ২৫ দিন পরেও কাটা জায়গায় ব্যথা? জানুন ১৮টি সম্ভাব্য কারণ

সিজারের পর কবে নিরাপদে সহবাস শুরু করা যায়?

চিকিৎসকরা সাধারণত সিজারিয়ান অপারেশনের পর পুনরায় সহবাস শুরু করার জন্য কমপক্ষে ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। এই সময়সীমাটিকে পোস্টপার্টাম পিরিয়ড (Postpartum Period) বলা হয়। তবে এটি একটি সাধারণ নির্দেশিকা, সবার জন্য এক নিয়ম নয়। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কিছু বিষয় নিশ্চিত করা জরুরি।


কেন এই ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করা প্রয়োজন?

১. জরায়ুর নিরাময়: প্রসবের পর জরায়ু সংকুচিত হয়ে তার আগের আকারে ও অবস্থানে ফিরে আসতে প্রায় ৬ সপ্তাহ সময় লাগে।
২. কাটা জায়গার নিরাময়: সি-সেকশনের সময় পেটের এবং জরায়ুর কাটা জায়গাটি সম্পূর্ণভাবে শুকিয়ে উঠতে এবং ভেতরের সেলাই মিলিয়ে যেতে এই সময়টা প্রয়োজন। এর আগে সহবাস করলে কাটা জায়গায় চাপ পড়তে পারে এবং ব্যথা হতে পারে।
৩. প্রসব-পরবর্তী রক্তপাত (Lochia): অপারেশনের পর কয়েক সপ্তাহ ধরে যোনিপথে যে রক্ত বা স্রাব নির্গত হয়, তা পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত সহবাস করলে ইনফেকশনের ঝুঁকি বাড়ে।


শারীরিকভাবে সেক্সের জন্য প্রস্তুতি কিভাবে বুঝবেন?

আপনার শরীর পুনরায় সহবাসের জন্য প্রস্তুত কি না, তা বোঝার কিছু লক্ষণ রয়েছে:

  • চিকিৎসকের সবুজ সংকেত: ৬ সপ্তাহ পর আপনার পোস্টপার্টাম চেক-আপে চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন। তিনি আপনার কাটা জায়গা ও সার্বিক স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে অনুমতি দিলেই এগোনো নিরাপদ।
  • ব্যথামুক্ত থাকা: আপনার কাটা জায়গায় বা পেটে যদি কোনো ব্যথা বা অস্বস্তি না থাকে।
  • রক্তপাত বন্ধ হওয়া: লোকিয়া বা প্রসব-পরবর্তী স্রাব সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে কি না, তা নিশ্চিত করুন।

সিজারের পর ব্যথা কমাতে কোন অবস্থায় সহবাস করবেন?

পুনরায় সহবাস শুরু করার সময় ব্যথা বা অস্বস্তি হওয়াটা স্বাভাবিক। কিছু কৌশল অবলম্বন করলে এই অস্বস্তি কমানো যায়:

  • আরামদায়ক পজিশন: এমন কোনো যৌন অবস্থান বেছে নিন যেখানে আপনার পেটে বা কাটা জায়গায় কোনো চাপ পড়বে না। যেমন:
    • পাশে ফিরে শোয়া (Spooning): এই পজিশনে পেটে কোনো চাপ পড়ে না।
    • নারী উপরে থাকা (Woman-on-top): এই অবস্থানে নারী তার নিজের সুবিধা অনুযায়ী গতি ও গভীরতা নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।
  • ধীরে শুরু করুন: প্রথমদিকে তাড়াহুড়ো না করে ধীরে এবং কোমলভাবে শুরু করুন।
  • ব্যথা হলে থেমে যান: যদি সামান্যতম ব্যথা বা অস্বস্তি হয়, তবে সাথে সাথে থেমে যান এবং আপনার সঙ্গীকে জানান।

আরও পড়ুন:নিয়মিত বাদাম খাওয়ার ১৬টি জাদুকরী উপকারিতা

সংক্রমণ ঝুঁকি কমাতে পুনরায় সহবাসের সময় কি করণীয়?

ইনফেকশন প্রতিরোধ করা এই সময়ে অত্যন্ত জরুরি।

  • পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা: সহবাসের আগে ও পরে যৌনাঙ্গ পরিষ্কার রাখুন।
  • লুব্রিকেন্ট ব্যবহার: হরমোনের পরিবর্তনের কারণে যোনিপথ শুষ্ক থাকতে পারে, যা ব্যথা ও ছিলে যাওয়ার কারণ হতে পারে। অস্বস্তি এড়াতে ওয়াটার-বেসড লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করুন।
  • কনডম ব্যবহার: কনডম একদিকে যেমন গর্ভধারণ রোধ করে, তেমনই ইনফেকশনের ঝুঁকিও কমাতে সাহায্য করে।

মনস্তাত্ত্বিকভাবে যৌন ইচ্ছা ফিরে আনতে কী করবেন?

শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি মানসিক প্রস্তুতিও সমান গুরুত্বপূর্ণ। অনেক মায়েরই সিজারের পর যৌন ইচ্ছা কমে যায়। এর কারণ হতে পারে:

  • ক্লান্তি ও ঘুমের অভাব
  • হরমোনের পরিবর্তন
  • কাটা দাগ বা শারীরিক পরিবর্তন নিয়ে হীনমন্যতা
  • ব্যথা বা অস্বস্তির ভয়

যৌন ইচ্ছা ফিরে আনার উপায়:

  • খোলামেলা আলোচনা: আপনার সঙ্গী বা স্বামীর সাথে নিজের অনুভূতি, ভয় বা অস্বস্তি নিয়ে কথা বলুন। তার থেকে মানসিক সাপোর্ট চান।
  • ধৈর্য ধরুন: নিজেকে সময় দিন। জোর করে কিছু করার চেষ্টা করবেন না।
  • ঘনিষ্ঠতা বাড়ান: সহবাস ছাড়াও একে অপরকে জড়িয়ে ধরা, চুম্বন বা ম্যাসাজের মাধ্যমে ঘনিষ্ঠতা বজায় রাখুন।
  • নিজের জন্য সময় বের করুন: শিশুর যত্ন নেওয়ার পাশাপাশি নিজের যত্ন নিন। হালকা ব্যায়াম, মেডিটেশন বা পছন্দের কোনো কাজ করলে মন ভালো থাকবে।

গর্ভধারণের বিষয়ে সতর্কতা

সিজারের পর জরায়ু সম্পূর্ণ সুস্থ হতে সময় লাগে। তাই পরবর্তী সন্তান নেওয়ার জন্য চিকিৎসকরা সাধারণত কমপক্ষে ১৮ থেকে ২৪ মাস অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। এই সময়ে গর্ভধারণ এড়াতে একটি নির্ভরযোগ্য জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি (যেমন—কনডম, পিল, ইনজেকশন) ব্যবহার করুন।


যৌনসম্পর্কের সময় পুঁজ বা রক্তপাত কেন হয়?

এর পেছনে বেশ কিছু সম্ভাব্য কারণ থাকতে পারে, যা সাধারণ থেকে শুরু করে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে।

১. সংক্রমণ (Infections):

  • যৌনবাহিত রোগ (STIs): ক্ল্যামাইডিয়া, গনোরিয়া, ট্রাইকোমোনিয়াসিস বা হার্পিসের মতো যৌনবাহিত রোগগুলো যোনি বা সারভিক্সে প্রদাহ সৃষ্টি করে, যার ফলে পুঁজ, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব এবং রক্তপাত হতে পারে। [, 295]
  • পেলভিক ইনফ্ল্যামেটরি ডিজিজ (PID): এটি জরায়ু, ফ্যালোপিয়ান টিউব বা ডিম্বাশয়ের একটি গুরুতর সংক্রমণ, যা যৌনমিলনের সময় ব্যথা ও রক্তপাত ঘটাতে পারে।
  • ভ্যাজাইনাল ইনফেকশন: ব্যাকটেরিয়াল ভ্যাজাইনোসিস বা ইস্ট ইনফেকশনের কারণেও স্রাব ও চুলকানি হতে পারে, যা থেকে ঘষা লেগে রক্তপাত হতে পারে।

২. শারীরিক কারণ:

  • সারভিকাল পলিপ (Cervical Polyp): জরায়ুমুখে আঙুরের মতো ছোট মাংসপিণ্ড, যা থেকে ঘষা লেগে রক্তপাত হতে পারে।
  • সারভিকাল এক্ট্রোপিয়ন (Cervical Ectropion): জরায়ুমুখের ভেতরের নরম কোষ বাইরে চলে এলে সহজেই রক্তপাত হতে পারে। এটি সাধারণত হরমোনের পরিবর্তনের কারণে হয়।
  • যোনিপথের শুষ্কতা (Vaginal Dryness): মেনোপজ, ব্রেস্টফিডিং বা হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে যোনিপথ শুষ্ক থাকলে ঘষা লেগে টিস্যু ছিঁড়ে যেতে পারে এবং রক্তপাত হতে পারে। [, 298]
  • এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis): জরায়ুর ভেতরের টিস্যু বাইরে বেড়ে উঠলে তা যৌনমিলনের সময় ব্যথা ও রক্তপাত ঘটাতে পারে।

৩. গুরুতর স্বাস্থ্য সমস্যা:

  • সারভিকাল বা জরায়ুর ক্যান্সার: যদিও এটি বিরল, তবে যৌনমিলনের পর অস্বাভাবিক রক্তপাত সারভিকাল, যোনি বা জরায়ুর ক্যান্সারের প্রাথমিক লক্ষণ হতে পারে।

করণীয় কী?

যৌনসম্পর্কের সময় পুঁজ বা রক্তপাত দেখা দিলে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো নেওয়া উচিত:

১. চিকিৎসকের পরামর্শ নিন:

  • অবহেলা করবেন না: প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হলো একজন গাইনিকোলজিস্ট বা স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে দ্রুত যোগাযোগ করা। তিনি সঠিক কারণ নির্ণয় করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার পরামর্শ দেবেন।
  • সঠিক তথ্য দিন: আপনার উপসর্গ, যেমন—কতদিন ধরে হচ্ছে, ব্যথার ধরন, স্রাবের রঙ ও গন্ধ ইত্যাদি সম্পর্কে চিকিৎসককে বিস্তারিত জানান।

২. যৌনমিলন থেকে বিরত থাকুন:

  • কারণ নির্ণয় এবং চিকিৎসা সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত যৌনমিলন থেকে বিরত থাকুন। এটি সংক্রমণ ছড়ানো বা সমস্যা আরও বাড়ার ঝুঁকি কমাবে।

৩. পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখুন:

  • যৌনাঙ্গ পরিষ্কার ও শুকনো রাখুন। সুগন্ধিযুক্ত সাবান বা স্প্রে ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকুন, কারণ এগুলি জ্বালা বা প্রদাহ বাড়াতে পারে।

৪. সঙ্গীকে জানান এবং পরীক্ষাও করান:

  • আপনার সঙ্গীকে বিষয়টি জানান। যদি এটি কোনো যৌনবাহিত রোগ (STI) হয়, তবে আপনার সঙ্গীরও চিকিৎসা করানো প্রয়োজন, অন্যথায় পুনরায় সংক্রমণের ঝুঁকি থেকে যাবে।

৫. চিকিৎসা সম্পূর্ণ করুন:

  • চিকিৎসক যদি কোনো অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্য কোনো ওষুধ দেন, তবে কোর্স সম্পূর্ণ করুন। মাঝপথে ওষুধ বন্ধ করলে সংক্রমণ পুরোপুরি সারবে না।

যে লক্ষণগুলো দেখলে জরুরিভাবে হাসপাতালে যাবেন:

  • অতিরিক্ত রক্তপাত: যদি রক্তপাত এত বেশি হয় যে এক ঘণ্টায় একটি প্যাড বা ট্যাম্পন ভিজে যায়।
  • তীব্র পেটব্যথা বা জ্বর: এটি গুরুতর সংক্রমণের লক্ষণ হতে পারে।
  • মাথা ঘোরা বা অজ্ঞান হয়ে যাওয়া।

যৌনসম্পর্কের সময় পুঁজ বা রক্তপাত একটি সতর্ক সংকেত, যা কোনো অন্তর্নিহিত স্বাস্থ্য সমস্যার ইঙ্গিত দেয়। লজ্জা বা ভয় না পেয়ে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ। সঠিক সময়ে চিকিৎসা করালে বেশিরভাগ সমস্যাই সম্পূর্ণভাবে নিরাময় করা সম্ভব এবং এটি আপনাকে দীর্ঘমেয়াদী জটিলতা থেকে রক্ষা করবে।


FAQ: সিজারের পর যৌন জীবন নিয়ে সাধারণ প্রশ্ন

প্রশ্ন: ৬ সপ্তাহের আগেই যদি নিজেকে সুস্থ মনে হয়, তবে কি সহবাস করা যাবে?
উত্তর: চিকিৎসকরা ৬ সপ্তাহ অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন, কারণ ভেতরের নিরাময় প্রক্রিয়া বাইরে থেকে বোঝা যায় না। তাই ঝুঁকি না নিয়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলাই বুদ্ধিমানের কাজ।

প্রশ্ন: সহবাসের সময় কাটা জায়গায় ব্যথা হলে কী করব?
উত্তর: ব্যথা হলে সাথে সাথে থেমে যান। অন্য কোনো আরামদায়ক পজিশন চেষ্টা করতে পারেন। যদি ব্যথা持续 থাকে, তবে কয়েকদিন অপেক্ষা করে আবার চেষ্টা করুন। ব্যথা না কমলে চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।

প্রশ্ন: সিজারের পর যৌন ইচ্ছা কমে যাওয়া কি স্বাভাবিক?
উত্তর: হ্যাঁ, এটি খুবই স্বাভাবিক। শারীরিক পরিবর্তন, হরমোন, ক্লান্তি এবং মানসিক চাপের কারণে এমনটা হতে পারে। সঙ্গীর সাথে খোলামেলা আলোচনা করুন এবং নিজেকে সময় দিন।

প্রশ্ন: লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করা কি জরুরি?
উত্তর: জরুরি নয়, তবে সহায়ক। ব্রেস্টফিডিং-এর কারণে শরীরে ইস্ট্রোজেন হরমোনের মাত্রা কম থাকে, যা যোনিপথকে শুষ্ক করে তোলে। লুব্রিকেন্ট ব্যবহার করলে সহবাস আরামদায়ক হয়।


শেষ কথা

সিজারের পর পুনরায় যৌন জীবনে ফেরা একটি ধীর এবং সংবেদনশীল প্রক্রিয়া। এখানে কোনো তাড়াহুড়োর স্থান নেই। আপনার শরীর ও মনের কথা শুনুন, সঙ্গীর সাথে বোঝাপড়া বজায় রাখুন এবং প্রয়োজনে চিকিৎসকের সাহায্য নিন। মনে রাখবেন, আপনার সুস্থতাই আপনার এবং আপনার পরিবারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।


Share This Post