ভারতে বর্ষাকাল এলেই যে দুই–তিনটি রোগের নাম সবচেয়ে ভয়ের, তার মধ্যে চিকুনগুনিয়া একটি। বড় শহর থেকে ছোট চা-বাগান বা গ্রাম—সব জায়গাতেই এই রোগের কথা শোনা যায়। আসলে মশার সংখ্যা বেড়ে গেলে এই ভাইরাস খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শব্দটা কঠিন মনে হলেও রোগটা ঠিক কী, কীভাবে ছড়ায়, কী লক্ষণ দেখা দেয়, কীভাবে চিকিৎসা করতে হয়—এসবই সহজ ভাষায় এখানে ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
Chikungunya: চিকুনগুনিয়া কী?
চিকুনগুনিয়া হলো একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যার মূল বাহক এডিস মশা—এডিস এজিপ্টি ও এডিস অ্যালবোপিক্টাস। এই একই মশা ডেঙ্গু এবং জিকা ভাইরাস ছড়ায়। রোগটির নাম এসেছে আফ্রিকার একটি ভাষা থেকে, যার অর্থ “ঝুঁকে থাকা” বা “বাঁকা হয়ে যাওয়া”—কারণ এই রোগে জয়েন্ট বা সন্ধির ব্যথা এত তীব্র হয় যে অনেক রোগী সোজা হয়ে হাঁটতেও কষ্ট পায়।
সহজ বাংলায় বললে, চিকুনগুনিয়া একটি সংক্রামক রোগ যা তীব্র জ্বর, প্রচণ্ড জয়েন্ট পেইন, শরীর ব্যথা, দুর্বলতা এবং র্যাশ তৈরি করে।
আরও পড়ুন:Winter Skin Care Tips:শীতে ত্বকের যত্নের ঘরোয়া উপায়
Chikungunya: চিকুনগুনিয়া কীভাবে ছড়ায়?
যে মশা এই রোগ ছড়ায়, সে হলো এডিস মশা। এই মশার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হলো এটি রাতে নয়, বরং দিনে কামড়ায়। সকাল সকাল এবং বিকেলের দিকে এরা বেশি সক্রিয় থাকে। ভারতের গরম ও আর্দ্র আবহাওয়া, আর বর্ষাকালের জমে থাকা জল—এডিস মশার জন্য আদর্শ পরিবেশ।
গাড়ির টায়ার, কুলার, ফুলের টব, জমে থাকা বৃষ্টির জল, খোলা ড্রাম—এগুলোয় সামান্য জল থাকলেই এডিস মশা ডিম দেয়। এমনকি একটি ছোট বোতলের ঢাকায় জমে থাকা জলও এই মশার জন্য যথেষ্ট।
Chikungunya symptoms – চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ :
চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ সাধারণত মশার কামড়ের ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে দেখা যায়। প্রথমেই আসে হঠাৎ খুব বেশি জ্বর। এই জ্বরের সঙ্গে সঙ্গে শরীরে যে ব্যথা হয়, সেটাই রোগটিকে আলাদা করে চিনতে সাহায্য করে। জ্বর হঠাৎ বেড়ে গিয়ে ১০২–১০৪ ডিগ্রিতে পৌঁছে যেতে পারে, আর সঙ্গে থাকে প্রচণ্ড জয়েন্ট পেইন—হাতের কবজি, আঙুল, হাঁটু, কোমর, পায়ের গোড়ালি—সব জায়গায় ব্যথা টের পাওয়া যায়। অনেক সময় ব্যথা এতটাই তীব্র হয় যে রোগী ঠিকমতো হাঁটতে পারে না।
শরীর ব্যথা, মাথা ব্যথা, চোখে চাপ অনুভব করা, অত্যধিক ক্লান্তি—এগুলোও খুব সাধারণ লক্ষণ। অনেকের ক্ষেত্রে র্যাশ দেখা দেয়, সাধারণত লালচে রঙের চিটচিটে দাগের মতো। এসবের পাশাপাশি হালকা বমিভাব বা বমি, জয়েন্ট ফুলে যাওয়া বা শক্ত হয়ে যাওয়ার মতো সমস্যাও দেখা যায়।
চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গুর পার্থক্য
অনেকেই মনে করেন চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু একই রোগ, কারণ লক্ষণগুলো অনেকটা মিলে যায়। তবে দুটির প্রধান পার্থক্য হলো—ডেঙ্গুতে প্লেটলেট কমে যায় এবং রক্তপাতের ঝুঁকি বেশি থাকে, কিন্তু চিকুনগুনিয়াতে সাধারণত প্লেটলেট কমে না। আর সবচেয়ে বড় পার্থক্য হলো জয়েন্ট পেইন—চিকুনগুনিয়াতে ব্যথা অনেক বেশি ও তীব্র হয়।
চিকুনগুনিয়া টেস্ট কীভাবে হয়?
চিকুনগুনিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে ডাক্তার কয়েকটি পরীক্ষা করতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে IgM ELISA টেস্ট, যা পাঁচ দিন পর থেকে পজিটিভ দেখাতে শুরু করে। আর RT-PCR টেস্ট থাকে সবচেয়ে নির্ভুল—এটি রোগের প্রথম তিন–চার দিনের মধ্যে ভাইরাস শনাক্ত করতে পারে। ডাক্তার প্রয়োজনে রক্তের CBC টেস্টও করেন, যাতে প্লেটলেট বা অন্যান্য উপাদান ঠিক আছে কিনা বোঝা যায়। অনেক সময় এলাকায় প্রাদুর্ভাব থাকলে ডাক্তার শুধুই লক্ষণের উপর ভিত্তি করে চিকুনগুনিয়া ধরতে পারেন।
চিকুনগুনিয়ার চিকিৎসা—কী করলে ভাল হবে?
চিকুনগুনিয়ার জন্য এখনো কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ওষুধ নেই। চিকিৎসা মানে মূলত জ্বর কমানো, ব্যথা কমানো আর শরীরকে সাপোর্ট করা। ডাক্তার সাধারণত প্যারাসিটামল দিতে বলেন, আর ব্যথা খুব বেশি হলে NSAID দিতে পারেন—তবে ডেঙ্গু সন্দেহ থাকলে এই ওষুধগুলো দেওয়া হয় না।
শরীরকে সুস্থ হতে সাহায্য করতে প্রচুর জল খাওয়া অত্যন্ত জরুরি। জল, ওআরএস, ডাবের জল, স্যুপ—সবই উপকারী। পাশাপাশি বিশ্রাম দরকার। গরম সেঁক দিলে জয়েন্টের ব্যথা একটু কমে। ব্যথা কমে এলে হালকা স্ট্রেচিং ভালো, কারণ পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে থাকলে জয়েন্ট আরও শক্ত হয়ে যায়।
অনেকে গিলয়, আশ্বগন্ধা বা হলুদ-দুধের মতো আয়ুর্বেদিক উপাদান ব্যবহার করেন, তবে ডাক্তারকে জিজ্ঞেস করেই নেওয়া ভালো।
চিকুনগুনিয়ার র্যাশ—কেন হয়?
এই ভাইরাস ত্বকের ক্ষুদ্র রক্তনালিগুলোকে উত্তেজিত করে, যার ফল হিসেবে লালচে র্যাশ দেখা দেয়। র্যাশ সাধারণত শরীরের ওপরের অংশ, হাত-পা ও পিঠে দেখা যায়। অনেকের ক্ষেত্রে একটু চুলকায়, তবে চুলকাতে থাকা ভালো নয়—ত্বকে ক্ষত তৈরি হতে পারে। সাধারণত তিন থেকে সাত দিনের মধ্যে র্যাশ মিলিয়ে যায়।
চিকুনগুনিয়ায় সুস্থ হতে কত সময় লাগে?
এটি এমন একটি প্রশ্ন যা প্রায় সবাই করে। সাধারণত জ্বর তিন থেকে পাঁচ দিনের মধ্যেই কমে যায়। শরীর ব্যথা আর জয়েন্টের ব্যথা দুই সপ্তাহ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারে, অনেক সময় আরও বেশি। ক্লান্তি বা দুর্বলতা প্রায় তিন সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে। বেশিরভাগ মানুষ এক থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারেন।
তবে কিছু মানুষের ক্ষেত্রে ব্যথা এক মাসেরও বেশি থাকতে পারে। যাদের আগে থেকেই আর্থ্রাইটিস আছে, বয়স্ক ব্যক্তি, বা যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম—তাদের ক্ষেত্রে ব্যথা দীর্ঘস্থায়ী হলে ডাক্তার বিশেষ ওষুধ বা ফিজিওথেরাপি দিতে পারেন।
চিকুনগুনিয়া ভ্যাকসিন—এখন আছে কি?
এখনো ভারতে কোনো চিকুনগুনিয়া ভ্যাকসিন সর্বসাধারণের জন্য পাওয়া যায় না। বিভিন্ন দেশে কিছু ভ্যাকসিন শেষ পর্যায়ের গবেষণায় রয়েছে। ভবিষ্যতে ভ্যাকসিন পাওয়া সম্ভব হলেও, আপাতত একমাত্র সুরক্ষা হলো মশা নিয়ন্ত্রণ।
কাদের জন্য চিকুনগুনিয়া বেশি ঝুঁকিপূর্ণ?
বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানুষ সুস্থ হয়ে যায়, তবে বয়স্ক ব্যক্তি, গর্ভবতী মহিলা, ডায়াবেটিস বা হার্টের রোগী, শিশু এবং দুর্বল ইমিউনিটি-ওয়ালা মানুষদের জন্য রোগটি কিছুটা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
কিভাবে প্রতিরোধ করবেন?
যেহেতু রোগটির কোনো ভ্যাকসিন নেই, তাই আমাদের হাতের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো মশা বংশবিস্তার বন্ধ করা। বাড়ির ভেতর-বাইরে জমে থাকা জল সপ্তাহে অন্তত একবার পরিষ্কার করা খুব জরুরি। কুলার, টবের প্লেট, ড্রাম—সবই নিয়মিত ধুয়ে ফেলতে হবে। মশা প্রতিরোধক ক্রিম, স্প্রে বা কয়েল ব্যবহার করা উচিত। সকালে ও বিকেলে পুরো হাত-পা ঢাকা জামা পরলে ভালো। দরজা-জানালায় নেট দিলে মশা ঢোকার সম্ভাবনা কমে যায়। আর পরিবারের বাচ্চা ও বয়স্কদের জন্য মশারি খুবই কার্যকর।
শিশুদের চিকুনগুনিয়া—কী জানা জরুরি?
শিশুরা অনেক সময় দ্রুত সেরে ওঠে, তবে তাদের জ্বর বেশি হতে পারে এবং র্যাশ বা বমি দেখা দিতে পারে। সবচেয়ে জরুরি হলো তাদের যথেষ্ট জল খাওয়ানো এবং সবসময় পর্যবেক্ষণে রাখা। কোনো অস্বাভাবিক লক্ষণ দেখলে দ্রুত ডাক্তার দেখানো উচিত।
চিকুনগুনিয়া নিয়ে প্রচলিত ভুল ধারণা
অনেকে মনে করেন চিকুনগুনিয়া মানুষে মানুষে ছড়ায়—এটি ভুল। শুধুমাত্র মশার কামড়েই ভাইরাসটি ছড়াতে পারে। কেউ কেউ আবার মনে করেন পেঁপের পাতার রস চিকুনগুনিয়া সারিয়ে দেয়—এটাও ভুল ধারণা। পেঁপের পাতার রস ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্লেটলেট বাড়াতে সাহায্য করে বলা হলেও চিকুনগুনিয়ার ক্ষেত্রে এর কোনো বৈজ্ঞানিক প্রমাণ নেই। আবার অনেকে অ্যান্টিবায়োটিক খেয়ে ফেলেন, কিন্তু ভাইরাসের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক কোনো কাজই করে না।
চিকুনগুনিয়ার সময় খাবারদাবার কেমন হওয়া উচিত?
সুস্থ হতে খাবারের ভূমিকা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ফলমূল, ডাবের জল, স্যুপ, সবজি, হালকা ভাত বা ডাল—এসব শরীরকে শক্তি দেয় এবং জ্বরের ক্লান্তি কমায়। ভাজাভুজি, অতিরিক্ত মশলাদার বা তৈলাক্ত খাবার, আর অতিরিক্ত চা-কফি এড়িয়ে যাওয়াই ভালো।
প্রায়শই জিজ্ঞাসা করা কিছু প্রশ্ন
চিকুনগুনিয়া ইংরেজিতে কী?
এটি একটি ভাইরাসজনিত রোগ, যা এডিস মশার মাধ্যমে ছড়ায়।
সুস্থ হতে কত সময় লাগে?
সাধারণত এক থেকে তিন সপ্তাহ, তবে জয়েন্ট পেইন কিছু মানুষের ক্ষেত্রে মাসখানেক স্থায়ী হতে পারে।
চিকুনগুনিয়া টেস্ট কখন করা উচিত?
উচ্চ জ্বরের সঙ্গে তীব্র জয়েন্ট পেইন থাকলে ডাক্তার টেস্টের পরামর্শ দিতে পারেন।
ডেঙ্গু আর চিকুনগুনিয়া কি একসঙ্গে হতে পারে?
হ্যাঁ, হতে পারে—এবং এতে সমস্যা বাড়তে পারে।
মশা ছাড়া কি রোগটি ছড়ায়?
না, একেবারেই না।
