স্বামী–স্ত্রীর ব্লাড গ্রুপ একই (যেমন B+) হলে সাধারণত গর্ভধারণে কোনো সরাসরি সমস্যা হয় না; বাস্তবে ঝুঁকির মূল বিষয় ABO মিসম্যাচ নয়, বরং Rh ফ্যাক্টর (বিশেষত Rh- মা ও Rh+ বাবা) এবং খুব বিরল ক্ষেত্রে কিছু “মাইনর” রেড সেল অ্যান্টিজেনের (যেমন Duffy, Kell, Kidd ইত্যাদি) অ্যান্টিবডি–সম্পর্কিত জটিলতা। তাই বিয়ে/গর্ভধারণের আগে–পরে রুটিন রক্তপরীক্ষা, অ্যান্টিবডি স্ক্রিন (Indirect Coombs Test), Rh নেগেটিভ হলে উপযুক্ত সময়ে অ্যান্টি‑D ইনজেকশন এবং প্রসব–পরবর্তী নবজাতকের পর্যবেক্ষণ—এসব করলেই অধিকাংশ ঝুঁকি প্রতিরোধযোগ্য।
ব্লাড গ্রুপ আসলে কী
- ABO সিস্টেম: A, B, AB, O—লাল রক্তকণিকার ওপর নির্দিষ্ট “অ্যান্টিজেন” (চিহ্ন); যেমন B মানে B অ্যান্টিজেন আছে।
- Rh ফ্যাক্টর: Rh D অ্যান্টিজেন থাকলে Rh+, না থাকলে Rh−। তাই একটি পূর্ণ রক্তের ধরন লিখি B+ বা B−।
- মাইনর/অন্য সিস্টেম: Duffy (Fy), Kell (K), Kidd (Jk), MNS ইত্যাদি—সাধারণ কথোপকথনে আমরা বলি না, কিন্তু গর্ভাবস্থায় বিরল কিছু ক্ষেত্রে এর অ্যান্টিবডি সমস্যা করতে পারে।
মূল কথা: বাবা–মায়ের ABO গ্রুপ একই হলেই জটিলতা হয়—এ ধারণা ভুল। সাধারণত ABO মিল–অমিল গর্ভধারণে গুরুতর সমস্যা তৈরি করে না; ব্যতিক্রম হলো Rh ফ্যাক্টর ও কিছু মাইনর অ্যান্টিজেনের অ্যান্টিবডি।
কোন পরিস্থিতিতে ঝুঁকি থাকে
১) Rh incompatibility (সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্লিনিক্যাল বিষয়)
- যদি মা Rh− (যেমন B−) এবং বাবা Rh+ হন, তবে সন্তানের Rh+ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- প্রথম গর্ভধারণে মায়ের শরীরে Rh অ্যান্টিবডি না-ও থাকতে পারে; প্রসব/অ্যাবরশন/রক্তক্ষরণে বা আঘাতে ভ্রূণের রক্ত মায়ের রক্তে গেলে মায়ের ইমিউন সিস্টেম Rh D-এর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বানাতে পারে।
- পরের গর্ভধারণে ভ্রূণ Rh+ হলেই ওই অ্যান্টিবডি প্লাসেন্টা পেরিয়ে ভ্রূণের লাল কণিকা ভেঙে দিতে পারে—একে বলে Hemolytic Disease of Fetus/Newborn (HDFN)।
- সমাধান: Rh− মাকে নির্দিষ্ট সময়সূচিতে Anti‑D (Rho(D) immune globulin) দেওয়া—এটাই বিশ্বজুড়ে স্ট্যান্ডার্ড প্রতিরোধ।
নোট: মা Rh+ হলে সাধারণত Rh incompatibility সমস্যা হয় না—মা ইতিমধ্যে “D” অ্যান্টিজেন বহন করেন বলে এই অ্যান্টিজেনের বিরুদ্ধে ক্ষতিকর অ্যান্টিবডি গঠন হয় না।
২) মাইনর রেড সেল অ্যান্টিজেন (যেমন Duffy/Kell/Kidd)
- খুব বিরলভাবে মায়ের শরীরে এই অ্যান্টিজেনগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি থাকলে (আগের গর্ভপাত/রক্ত সঞ্চালন/প্রাকৃতিক সেন্সিটাইজেশন), পরের গর্ভে শিশুর ওই অ্যান্টিজেন থাকলে হেমোলাইসিস হতে পারে।
- উদাহরণ (সহজ করে): বাবা Duffy-পজিটিভ আর মা Duffy-নেগেটিভ; প্রথম গর্ভে সামান্য ফিটাল রক্ত মায়ের রক্তে গেলে মায়ের অ্যান্টিবডি তৈরি হলো; পরের গর্ভে শিশুটি Duffy-পজিটিভ হলে এই অ্যান্টিবডি শিশুর লোহিত কণিকা ভাঙতে পারে।
- সমাধান: প্রেগন্যান্সির শুরুতে Antibody Screen (Indirect Coombs Test); পজিটিভ হলে টাইপিং–টাইটার মনিটরিং, ফিটাল ডপলার (MCA PSV), প্রয়োজন হলে উচ্চতর সেন্টারে ফলো‑আপ/ইন্ট্রা‑ইউটেরাইন ট্রান্সফিউশনসহ বিশেষ ব্যবস্থাপনা।
৩) ABO incompatibility (সাধারণত মৃদু)
- মা O এবং শিশু A/B হলে নবজাতকে “ABO incompatibility jaundice” দেখা যেতে পারে—সাধারণত মৃদু থেকে মাঝারি; ফটোথেরাপিতেই ভালো হয়।
- গর্ভাবস্থায় Rh-এর মতো গুরুতর হেমোলাইটিক রোগ কমন নয়।
আরও পড়ুন: শিশুমনে কেন বাড়ছে জেদ? কারণ, সমাধান, এবং বাস্তব গাইড
তাহলে স্বামী–স্ত্রী দু’জনই যদি B+ হন?
- ABO একই (B), Rh–ও একই (পজিটিভ)। এই সংমিশ্রণে Rh incompatibility-এর ঝুঁকি থাকে না।
- তাত্ত্বিকভাবে বিরল মাইনর অ্যান্টিজেন (Duffy/Kell/Kidd)–ভিত্তিক সমস্যা সম্ভব—কিন্তু সেটি “B+” একই থাকার কারণে নয়; সেটা বাবার–মায়ের মাইনর অ্যান্টিজেন প্রোফাইল/পূর্ব ইতিহাসে সেন্সিটাইজেশনের ওপর নির্ভর করে।
- বাস্তবে রুটিন অ্যান্টিবডি স্ক্রিনিং–মনিটরিং করলে অধিকাংশ ঝুঁকি ধরা পড়ে ও সামাল দেওয়া যায়।
গর্ভধারণে করণীয়—প্র্যাক্টিক্যাল চেকলিস্ট
প্রথম ভিজিট/প্রি‑কনসেপশন
- ABO ও Rh টাইপিং (দু’জনেরই)।
- মায়ের Antibody Screen: Indirect Coombs Test (ICT)।
- প্রয়োজনমতো CBC, থাইরয়েড, ডায়াবেটিস স্ক্রিন, সংক্রমণ প্রোফাইল।
Rh− মা হলে
- নির্ধারিত সময়ে Anti‑D ইম্যুনোগ্লোবুলিন (সাধারণত 28 সপ্তাহে, প্রসব/অ্যাবরশন/আঘাত/ইনভেসিভ প্রোসিডিউরের পর)।
- প্রসবের পর শিশুর Rh+ হলে পোস্ট‑ডেলিভারি ডোজ।
Antibody Screen পজিটিভ হলে
- কোন অ্যান্টিবডি, টাইটার কত—সেটা মনিটর।
- মধ্য ত্রৈমাসিক থেকে MCA Doppler (ফিটাল অ্যানিমিয়ার সংকেত খোঁজা)।
- প্রয়োজন হলে উচ্চতর সেন্টারে রেফারেল।
ডেলিভারি–পোস্টনাটাল
- নবজাতকের রক্ত–জন্ডিস মনিটরিং; প্রয়োজন হলে ফটোথেরাপি/অন্যান্য ব্যবস্থা।
আরও পড়ুন:Frozen Shoulder |ফ্রোজেন শোল্ডার-সমস্যা ও চিকিৎসা
প্রচলিত ভুল ধারণা—সংক্ষেপে
- “একই ব্লাড গ্রুপ হলে বাচ্চা হবে না/সমস্যা হবেই”—ভুল।
- “ABO মিললেই সব নিরাপদ”—অসম্পূর্ণ। Rh স্ট্যাটাস–অ্যান্টিবডি স্ক্রিন গুরুত্বপূর্ণ।
- “Anti‑D শুধু প্রসবের পর লাগে”—আংশিক সত্য। মাঝপথে রক্তমিশ্রণের ঝুঁকি থাকলে গর্ভাবস্থাতেও নির্ধারিত ডোজ লাগে।
- “ABO incompatibility মানেই বড় জটিলতা”—সাধারণত নয়; অধিকাংশে মৃদু নবজাতক জন্ডিস।
সহজ ভাষায় সারসংক্ষেপ
- স্বামী–স্ত্রীর B+–B+ হলে সাধারণত গর্ভধারণে বিশেষ সমস্যা হয় না।
- Rh incompatibility মূল ইস্যু—মা Rh− হলে প্রতিরোধ জরুরি।
- বিরল মাইনর অ্যান্টিজেন–সম্পর্কিত ঝুঁকি আছে—তাই রুটিন অ্যান্টিবডি স্ক্রিন জরুরি।
- ধাপে ধাপে স্ক্রিনিং–মনিটরিং–প্রিভেনশন করলে মা–শিশু—দু’জনই নিরাপদ থাকেন।
FAQ
প্রশ্ন: স্বামী–স্ত্রী দু’জনই B+—কোনো টেস্ট লাগবে?
উত্তর: হ্যাঁ—রুটিন প্রি‑নাটাল প্যানেলের অংশ হিসেবে ABO/Rh নিশ্চিত করা, মায়ের Antibody Screen (ICT) করা উচিত। এতে Rh ছাড়াও বিরল অ্যান্টিবডি ধরা পড়ে।
প্রশ্ন: Rh incompatibility ঠিক কী?
উত্তর: মা Rh− আর শিশু Rh+ হলে মায়ের শরীরে Rh D–বিরোধী অ্যান্টিবডি তৈরি হতে পারে, যা পরের গর্ভে শিশুর লাল কণিকা ভেঙে দিতে পারে। Anti‑D ইনজেকশন দিয়ে এটি প্রতিরোধযোগ্য।
প্রশ্ন: ABO incompatibility কি বড় সমস্যা?
উত্তর: সাধারণত নয়। মা O এবং শিশু A/B হলে নবজাতকে মৃদু–মাঝারি জন্ডিস হতে পারে; ফটোথেরাপিতে বেশিরভাগই ভালো হয়।
প্রশ্ন: Duffy/Kell/Kidd এসব কেন শুনিনি?
উত্তর: এগুলো মাইনর রেড সেল অ্যান্টিজেন সিস্টেম। খুব কম ক্ষেত্রে এগুলোর বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি গর্ভে শিশুর রক্ত ভাঙতে পারে। তাই Antibody Screen করা হয়।
প্রশ্ন: কারা বেশি সতর্ক থাকব?
উত্তর: Rh− মা, পূর্বে গর্ভপাত/ব্লিডিং/ইনভেসিভ টেস্ট/রক্ত সঞ্চালনের ইতিহাস, নবজাতকে আনএক্সপ্লেইনড জন্ডিস–এসব থাকলে অ্যান্টিবডি স্ক্রিন–মনিটরিং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন: Anti‑D কখন দেওয়া হয়?
উত্তর: সাধারণত 28 সপ্তাহে প্রফিল্যাকটিক ডোজ, এবং প্রসব–পরবর্তী শিশুর Rh+ হলে আবার; এছাড়া অ্যাবরশন/আঘাত/ইনভেসিভ প্রোসিডিউরের পর দেওয়া হয়—ডোজ–টাইমিং চিকিৎসক ঠিক করবেন।
প্রশ্ন: B+–B+ হলে কি একদম নিশ্চিন্ত?
উত্তর: Rh–জনিত বড় ঝুঁকি নেই—এটাই বড় স্বস্তি। তবে রুটিন অ্যান্টিবডি স্ক্রিন–প্রেনাটাল কেয়ার–নবজাতক মনিটর—এসব ফলো করলে নিশ্চিন্ত থাকা যায়।
প্রশ্ন: আগের বাচ্চায় জন্ডিস ছিল—এবার কী করব?
উত্তর: প্রেগন্যান্সির শুরুতেই Antibody Screen করান; রিপোর্ট–ইতিহাস দেখে চিকিৎসক প্রয়োজনীয় মনিটরিং প্ল্যান দেবেন। নবজাতক জন্ডিস অধিকাংশ সময় ম্যানেজেবল, তবে আগেভাগে পরিকল্পনা থাকলে ঝুঁকি কমে।
প্রশ্ন: বিবাহের আগে ব্লাড গ্রুপ মেলানো দরকার?
উত্তর: বিবাহের “সামঞ্জস্য” নয়—গর্ভধারণে নিরাপত্তাই মূল বিষয়। বিয়ে/প্রেগন্যান্সির আগে দু’জনের ABO/Rh জানা, প্রেগন্যান্সির শুরুতে Antibody Screen—ই যথেষ্ট।
আরও পড়ুন:কিডনিতে পাথর (Kidney Stone): কারণ, লক্ষণ, চিকিৎসা, খাদ্যাভ্যাস, ওষুধ ও বিস্তারিত
শেষ কথা
স্বামী–স্ত্রীর রক্তের গ্রুপ একই হওয়া (যেমন B+)—সেটা নিজে কোনো সমস্যা নয়। প্রেগন্যান্সিতে যা গুরুত্বপূর্ণ—Rh স্ট্যাটাস, Antibody Screen, এবং নিয়মিত ফলো‑আপ। আধুনিক স্ক্রিনিং–প্রিভেনশন–নিওনেটাল কেয়ারে মা ও শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এখন নিয়মিত ক্লিনিক্যাল প্র্যাক্টিস। কোনো সন্দেহ/পূর্ব ইতিহাস থাকলে আগেভাগে গাইনোলজিস্ট/ফেটাল মেডিসিন–বিশেষজ্ঞের সঙ্গে পরিকল্পনা করুন।