বর্ষাকাল এলেই আমাদের মনে যে ভয়ের একটা চোরাস্রোত বয়ে যায়, তার মধ্যে ডেঙ্গু জ্বর অন্যতম। প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন, এবং এর তীব্রতা অনেক সময় মারাত্মক আকার ধারণ করে। ডেঙ্গু শুধু একটি জ্বর নয়, এটি একটি মশাবাহিত ভাইরাল সংক্রমণ যা সময়মতো চিহ্নিত না হলে এবং সঠিক পদক্ষেপ না নিলে প্রাণঘাতীও হতে পারে। আমাদের আশেপাশে ডেঙ্গু মশা সবসময়ই লুকিয়ে থাকে, তাই এর প্রাথমিক লক্ষণগুলো চেনা এবং সময়মতো প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে আমরা ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কী কী, ডেঙ্গু হলে কী করবেন, এবং কিছু কার্যকরী ঘরোয়া প্রতিকার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। মনে রাখবেন, ঘরোয়া প্রতিকারগুলো চিকিৎসার বিকল্প নয়, বরং দ্রুত সুস্থ হতে এবং জটিলতা এড়াতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ডেঙ্গু জ্বর কী এবং কীভাবে ছড়ায়?
ডেঙ্গু একটি ভাইরাস ঘটিত রোগ যা এডিস মশার (Aedes aegypti এবং Aedes albopictus) কামড়ের মাধ্যমে মানুষে ছড়ায়। এই মশাগুলো দিনের বেলায়, বিশেষ করে সকাল এবং সন্ধ্যার সময় বেশি কামড়ায়। ডেঙ্গু জ্বরকে “ব্রেকবোন ফিভার” বা হাড়ভাঙা জ্বরও বলা হয়, কারণ এর আক্রমণে হাড় ও জয়েন্টে তীব্র ব্যথা হয়। ডেঙ্গু ভাইরাস প্রধানত চার ধরনের হয় (DENV-1, DENV-2, DENV-3, DENV-4)। একবার এক ধরনের ডেঙ্গু হলে সেই ধরনের বিরুদ্ধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি হয়, কিন্তু অন্য ধরনের ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থেকে যায়। দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলে এর তীব্রতা অনেক সময় বেশি হয়, যা ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)-এর মতো মারাত্মক রূপ নিতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলো কী কী?
ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো সাধারণত মশার কামড় খাওয়ার ৪ থেকে ১০ দিনের মধ্যে দেখা দেয়। অনেক সময় ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো সাধারণ ফ্লু বা জ্বরের মতো মনে হতে পারে, তাই সতর্ক থাকা খুব জরুরি। ডেঙ্গুর লক্ষণগুলো কী কী? তা সঠিকভাবে জানা থাকলে দ্রুত রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসা শুরু করা সম্ভব।
ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলি হলো:
- তীব্র জ্বর: ডেঙ্গুর সবচেয়ে প্রধান লক্ষণ হলো হঠাৎ করে আসা তীব্র জ্বর, যা ১০২-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। এই জ্বর ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এটিই ডেঙ্গু জ্বর কত ডিগ্রি পর্যন্ত হয়? এই প্রশ্নের উত্তর।
- তীব্র মাথাব্যথা: কপালে বা চোখের পেছনে তীব্র ব্যথা হয়, যা অনেকের জন্য অসহনীয় হতে পারে।
- মাংসপেশী ও গাঁটে ব্যথা: ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হলে মাংসপেশী এবং হাড়ের জোড়ায় তীব্র ব্যথা হয়। এটি “হাড়ভাঙা জ্বর” নামে পরিচিতি পাওয়ার অন্যতম কারণ।
- শরীরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি: জ্বরের ২-৫ দিনের মধ্যে ত্বকে লালচে ফুসকুড়ি বা র্যাশ দেখা দিতে পারে, যা প্রথমে মুখ ও বুক থেকে শুরু হয়ে পরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই র্যাশগুলো চুলকানিযুক্ত হতে পারে।
- বমি বমি ভাব বা বমি: অনেক রোগীর বমি বমি ভাব হয় বা বারবার বমি হতে পারে।
- চোখের পেছনে ব্যথা: চোখের নড়াচড়ার সময় চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
- ক্লান্তি ও দুর্বলতা: ডেঙ্গু হলে শরীর খুব দুর্বল ও ক্লান্ত লাগে। ডেঙ্গু হলে কি ক্লান্ত লাগে? হ্যাঁ, ডেঙ্গু জ্বরে শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে রোগী সব সময় শুয়ে থাকতে চায় এবং দৈনন্দিন কাজ করতেও অনীহা বোধ করে।
- ক্ষুধামন্দা: খাবার গ্রহণে অনীহা দেখা দেয়।
শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ:
শিশুদের ক্ষেত্রে ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো প্রাপ্তবয়স্কদের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন হতে পারে। তারা প্রায়শই সাধারণ জ্বরের মতো উপসর্গ নিয়ে আসে, যেমন –
- তীব্র জ্বর।
- শরীরে র্যাশ।
- খাওয়ায় অনীহা।
- অতিরিক্ত ঘুমিয়ে পড়া বা বিরক্তি।
- মাথাব্যথা এবং পেটে ব্যথা। যদি আপনার বাচ্চাদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলো দেখেন, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত।
ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ:
জ্বর কমে যাওয়ার পর ডেঙ্গুর সবচেয়ে বিপজ্জনক পর্যায় শুরু হতে পারে। এই সময় কিছু সতর্কীকরণ লক্ষণ দেখা গেলে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া উচিত। এগুলো হলো:
- পেটে তীব্র ব্যথা।
- বারবার বমি হওয়া।
- নাক, দাঁতের মাড়ি বা মলদ্বারে রক্তপাত।
- ত্বকের নিচে লালচে ছোপ বা কালশিটে পড়া।
- অতিরিক্ত ক্লান্তি বা অস্থিরতা।
- শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া।
- হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া বা নীলচে হয়ে যাওয়া।
কিভাবে বুঝবেন ডেঙ্গু হয়েছে?
যদি উপরোক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে যেকোনো একটি বা একাধিক দেখা দেয়, বিশেষ করে যদি জ্বর থাকে এবং ডেঙ্গু প্রবণ এলাকায় বসবাস করেন, তাহলে দ্রুত রক্ত পরীক্ষা (NS1 Antigen Test, Dengue IgM/IgG Test) করিয়ে ডেঙ্গু নিশ্চিত করা উচিত।
ডেঙ্গু হলে কী করবেন?
ডেঙ্গু হলে panicked না হয়ে সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া খুব জরুরি। মনে রাখবেন, ডেঙ্গুর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ নেই, চিকিৎসা মূলত লক্ষণভিত্তিক এবং শরীরের তরল ব্যবস্থাপনার ওপর নির্ভর করে।
- ডাক্তারের পরামর্শ: ডেঙ্গুর লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে অবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিজে নিজে ঔষধ না খেয়ে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলুন। ডেঙ্গু জ্বর হলে কি ঔষধ খেতে হবে? হ্যাঁ, তবে প্যারাসিটামল ছাড়া অন্য কোনো ব্যথানাশক (যেমন অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন) ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
- পর্যাপ্ত বিশ্রাম: ডেঙ্গু শরীরকে ভীষণ দুর্বল করে দেয়। তাই এই সময় পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়া জরুরি। শরীরকে সুস্থ হতে সময় দিন।
- পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ: এটি ডেঙ্গুর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শরীরকে হাইড্রেটেড রাখা অত্যন্ত জরুরি। প্রচুর পরিমাণে জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল, ফলের রস (যেমন কমলার রস, পেঁপের রস), স্যুপ ইত্যাদি পান করুন। এটি পানিশূন্যতা রোধ করে। ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে? এই তরল খাবারগুলো শরীরের জল শূন্যতা পূরণ করে শক্তি যোগাবে।
- জ্বর নিয়ন্ত্রণ: জ্বরের জন্য ডাক্তার প্যারাসিটামল ঔষধ দেন। ডাক্তারের নির্দেশ অনুযায়ী প্যারাসিটামল সেবন করুন। জ্বর কমাতে কপালে বা সারা শরীরে ঠান্ডা জলের পট্টি দিতে পারেন।
- প্লেটলেট গণনা পর্যবেক্ষণ: ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে প্লেটলেট বা অণুচক্রিকার সংখ্যা কমে যাওয়া একটি সাধারণ সমস্যা। ডাক্তার নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে প্লেটলেটের মাত্রা পর্যবেক্ষণ করেন। প্লেটলেট খুব বেশি কমে গেলে রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ে এবং হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হতে পারে।
ডেঙ্গুতে বারবার জ্বর আসে কেন?
ডেঙ্গু জ্বরের একটি সাধারণ ধরন হলো “স্যাডলব্যাক ফিভার”, যেখানে প্রথম ২-৩ দিন জ্বর থাকে, তারপর ১-২ দিন জ্বর কমে আসে (এই সময়টিকে ‘ক্রিটিক্যাল পিরিয়ড’ বলা হয়) এবং এরপর আবার জ্বর আসতে পারে। এই দ্বিতীয় ধাপের জ্বরকে ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রতিক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা হয়।
জ্বর না কমলে কী করণীয়?
যদি প্যারাসিটামল খাওয়ার পরেও জ্বর না কমে বা আরও বেড়ে যায়, তাহলে দ্রুত ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। এটি ডেঙ্গুর গুরুতর লক্ষণের ইঙ্গিত হতে পারে।
ডেঙ্গু জ্বরের ঘরোয়া প্রতিকার ও সহায়ক টিপস
ডেঙ্গুর চিকিৎসায় ঔষধপত্রের পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া প্রতিকার এবং সাধারণ টিপস খুব সহায়ক হতে পারে। এগুলো শরীরকে সুস্থ হতে সাহায্য করে এবং রোগের তীব্রতা কমাতে সাহায্য করে।
- পেঁপে পাতার রস: ডেঙ্গু জ্বরে প্লেটলেট কমে গেলে পেঁপে পাতার রস বেশ কার্যকর বলে অনেকে মনে করেন। এতে থাকা কিছু এনজাইম প্লেটলেট বাড়াতে সাহায্য করে।
- ব্যবহার: কয়েকটি তাজা পেঁপে পাতা পরিষ্কার করে জল দিয়ে পিষে রস বের করে নিন। দিনে ২-৩ বার এক বা দুই চামচ এই রস পান করতে পারেন। তবে এটি অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ মেনে চলতে হবে।
- গিলয় রস: গিলয় বা গুলঞ্চ একটি আয়ুর্বেদিক ভেষজ যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে এবং জ্বর কমাতে সাহায্য করে।
- ব্যবহার: গিলয় গাছের কান্ড ছেঁচে রস বের করে বা গিলয় পাউডার জলে মিশিয়ে পান করতে পারেন।
- ডাবের জল: ডাবের জল প্রাকৃতিক ইলেকট্রোলাইটে ভরপুর এবং এটি শরীরকে দ্রুত হাইড্রেটেড করতে সাহায্য করে। জ্বরের কারণে হারিয়ে যাওয়া খনিজ পূরণ করতে এটি খুব উপকারী।
- তুলসি পাতা: তুলসি পাতা তার অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি এবং অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল গুণের জন্য পরিচিত। জ্বরের সময় তুলসি চায়ে (তুলসি পাতা ফুটিয়ে) চুমুক দিলে কিছুটা আরাম পাওয়া যায়।
- নিম পাতা: নিম পাতার মধ্যে অ্যান্টিভাইরাল উপাদান রয়েছে। নিম পাতা ফুটিয়ে সেই জল দিয়ে গোসল করলে বা নিম পাতার রস পান করলে জ্বর উপশমে সাহায্য হতে পারে। তবে, এর কার্যকারিতা নিয়ে আরও গবেষণার প্রয়োজন।
- ফল ও সবজি: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন কমলা, লেবু, কিউই এবং ডালিম ডেঙ্গু রোগীদের জন্য উপকারী। ডালিমের রস প্লেটলেট বাড়াতে সহায়ক বলে মনে করা হয়। এছাড়া, বিভিন্ন সবজির স্যুপ শরীরের শক্তি যোগায়।
- পর্যাপ্ত পুষ্টি: ডেঙ্গু শরীরকে দুর্বল করে দেয়, তাই এই সময় সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করা উচিত। ভাত, ডাল, নরম খিচুড়ি, মুরগির স্যুপ, সেদ্ধ সবজি ইত্যাদি খান। তেল-মসলাযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
২য় বার ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ এবং ৩য় বার ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ:
প্রথমবার ডেঙ্গু হলে সাধারণত হালকা থেকে মাঝারি উপসর্গ দেখা দেয়। তবে, যদি দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার অন্য কোনো ডেঙ্গু সেরোটাইপ দ্বারা আক্রান্ত হন, তাহলে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে। এই ক্ষেত্রে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (DSS) হওয়ার ঝুঁকি বাড়ে।
- লক্ষণ: রক্তপাত (নাক, মাড়ি, মল বা প্রস্রাবে), ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণের চিহ্ন, তীব্র পেটে ব্যথা, বারবার বমি, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি।
- ২য় বার ডেঙ্গু হলে করণীয়: দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি হওয়া উচিত। ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক।
ডেঙ্গু প্রতিরোধ:
ডেঙ্গুর কোনো নির্দিষ্ট ঔষধ না থাকায় প্রতিরোধই এর থেকে বাঁচার সেরা উপায়। যেহেতু এডিস মশা স্বচ্ছ ও জমে থাকা জলে ডিম পাড়ে, তাই আপনার বাড়ি এবং এর চারপাশ পরিষ্কার রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
- জল জমা বন্ধ করুন: বাড়ির আশেপাশে, ছাদে, টবে, পুরনো টায়ারে, এয়ার কুলারে বা যেকোনো পাত্রে যেন জল জমে না থাকে সেদিকে খেয়াল রাখুন। নিয়মিত (অন্তত সপ্তাহে একবার) এই স্থানগুলো থেকে জল ফেলে দিন বা শুকিয়ে নিন।
- মশারির ব্যবহার: দিনের বেলা ঘুমালে মশারি ব্যবহার করুন।
- মশা তাড়ানোর স্প্রে/লোশন: দিনে বা সন্ধ্যায় বাইরে গেলে মশা তাড়ানোর লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করুন।
- পোশাক: লম্বা হাতাযুক্ত পোশাক এবং ফুলপ্যান্ট পরুন।
- জানালা-দরজায় নেট: মশা ঘরে প্রবেশ আটকাতে জানালা ও দরজায় মশারোধী নেট ব্যবহার করুন।
উপসংহার
ডেঙ্গু জ্বর একটি গুরুতর জনস্বাস্থ্য সমস্যা, কিন্তু সঠিক জ্ঞান এবং সচেতনতা দিয়ে এর বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব। ডেঙ্গুর প্রাথমিক লক্ষণগুলো চেনা, দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া এবং পাশাপাশি কিছু ঘরোয়া প্রতিকার অবলম্বন করা আপনাকে দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো প্রতিরোধ। আপনার চারপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রেখে এবং মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করে ডেঙ্গু মুক্ত একটি সুস্থ জীবন নিশ্চিত করুন। আপনার সুস্থতাই আমাদের কাম্য।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)
প্রশ্ন ১: ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কি কি বাংলায়?
উত্তর: ডেঙ্গু জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলো হলো তীব্র জ্বর (১০২-১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত), তীব্র মাথাব্যথা (বিশেষ করে চোখের পেছনে), মাংসপেশী ও গাঁটে ব্যথা (হাড়ভাঙা ব্যথা), শরীরে র্যাশ বা ফুসকুড়ি, বমি বমি ভাব, এবং ক্লান্তি।
প্রশ্ন ২: ডেঙ্গু হলে কি ক্লান্ত লাগে?
উত্তর: হ্যাঁ, ডেঙ্গু হলে শরীর ভীষণ ক্লান্ত ও দুর্বল লাগে। এই ক্লান্তি এতটাই তীব্র হতে পারে যে রোগী সব সময় শুয়ে থাকতে চায় এবং দৈনন্দিন কাজে অনীহা বোধ করে।
প্রশ্ন ৩: ডেঙ্গু জ্বর কত ডিগ্রি পর্যন্ত হয়?
উত্তর: ডেঙ্গু জ্বর সাধারণত ১০২ থেকে ১০৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। এই জ্বর ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
প্রশ্ন ৪: ডেঙ্গু কি মা থেকে সন্তানে ছড়ায়?
উত্তর: খুব বিরল ক্ষেত্রে, গর্ভবতী মা থেকে তার গর্ভের সন্তানের মধ্যে ডেঙ্গু ছড়াতে পারে। তবে, এটি খুবই অস্বাভাবিক এবং সরাসরি মানুষ থেকে মানুষে ছড়ায় না, শুধুমাত্র মশার কামড়েই ছড়ায়।
প্রশ্ন ৫: কিভাবে বুঝবেন ডেঙ্গু হয়েছে?
উত্তর: যদি তীব্র জ্বর, মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা, এবং র্যাশের মতো লক্ষণগুলো দেখা দেয়, বিশেষ করে যদি ডেঙ্গু প্রবণ এলাকায় থাকেন, তাহলে দ্রুত রক্ত পরীক্ষা (যেমন NS1 Antigen Test বা Dengue IgM/IgG Test) করিয়ে ডেঙ্গু হয়েছে কিনা তা নিশ্চিত করা উচিত।
প্রশ্ন ৬: জ্বর না কমলে কী করণীয়?
উত্তর: যদি প্যারাসিটামল খাওয়ার পরেও জ্বর না কমে বা আরও বেড়ে যায়, তাহলে দ্রুত আপনার ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করুন। এটি ডেঙ্গুর গুরুতর লক্ষণের ইঙ্গিত হতে পারে এবং জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হতে পারে।
প্রশ্ন ৭: ডেঙ্গুতে বারবার জ্বর আসে কেন?
উত্তর: ডেঙ্গু জ্বরের একটি সাধারণ ধরন হলো “স্যাডলব্যাক ফিভার”, যেখানে প্রথম কয়েক দিন জ্বর থাকার পর ১-২ দিন কমে আসে এবং তারপর আবার জ্বর আসতে পারে। এই দ্বিতীয় ধাপের জ্বরটি ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রতি শরীরের প্রতিক্রিয়ার অংশ।
প্রশ্ন ৮: ২য় বার ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ এবং ৩য় বার ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কী?
উত্তর: দ্বিতীয় বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু হলে রোগের তীব্রতা অনেক বেশি হতে পারে এবং এটি ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) বা ডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS)-এর মতো মারাত্মক রূপ নিতে পারে। লক্ষণগুলির মধ্যে তীব্র পেটে ব্যথা, বারবার বমি, নাক-মাড়ি থেকে রক্তপাত, ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা এবং হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
প্রশ্ন ৯: শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ ও চিকিৎসা কী?
উত্তর: শিশুদের ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ প্রায়শই সাধারণ জ্বরের মতো হয়, যেমন তীব্র জ্বর, র্যাশ, খাওয়ায় অনীহা, অতিরিক্ত ঘুমিয়ে পড়া বা বিরক্তি। চিকিৎসার জন্য দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে, জ্বর নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে, এবং পর্যাপ্ত তরল পান করানোর দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
প্রশ্ন ১০: ডেঙ্গু জ্বরের ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ কী কী?
উত্তর: জ্বর কমে যাওয়ার পর ডেঙ্গুর ৭টি সতর্কীকরণ লক্ষণ হলো: পেটে তীব্র ব্যথা, বারবার বমি, নাক/মাড়ি/মলদ্বারে রক্তপাত, ত্বকের নিচে লালচে ছোপ/কালশিটে, অতিরিক্ত ক্লান্তি/অস্থিরতা, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, এবং হাত-পা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া। এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে জরুরি ভিত্তিতে হাসপাতালে যেতে হবে।
প্রশ্ন ১১: ডেঙ্গু রোগের প্রতিকার কী?
উত্তর: ডেঙ্গু রোগের কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ নেই। প্রতিকার মূলত লক্ষণভিত্তিক। পর্যাপ্ত বিশ্রাম, প্রচুর তরল পান করা (জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল), জ্বর নিয়ন্ত্রণের জন্য প্যারাসিটামল সেবন এবং প্লেটলেট গণনার নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা হয়। গুরুতর ক্ষেত্রে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিতে হয়।
প্রশ্ন ১২: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ কী?
উত্তর: ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে হঠাৎ তীব্র জ্বর, তীব্র মাথাব্যথা (বিশেষ করে চোখের পেছনে), মাংসপেশী ও গাঁটে তীব্র ব্যথা, শরীরে র্যাশ, বমি বমি ভাব, এবং ক্লান্তি। এটি সাধারণত গুরুতর হয় না যদি না কোনো জটিলতা দেখা দেয়।
প্রশ্ন ১৩: ২য় বার ডেঙ্গু হলে করণীয় কী?
উত্তর: দ্বিতীয়বার ডেঙ্গু হলে রোগের তীব্রতা বেশি হওয়ার ঝুঁকি থাকে। তাই এমন পরিস্থিতিতে কোনো ঝুঁকি না নিয়ে অবিলম্বে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ডাক্তারের নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা গ্রহণ করা উচিত।
প্রশ্ন ১৪: ডেঙ্গু জ্বর হলে কি ঔষধ খেতে হবে?
উত্তর: ডেঙ্গু জ্বর হলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল খাওয়া যেতে পারে জ্বর এবং ব্যথা কমানোর জন্য। অ্যাসপিরিন বা আইবুপ্রোফেন-এর মতো ঔষধ এড়িয়ে চলতে হবে কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায়।
প্রশ্ন ১৫: ডেঙ্গু জ্বর হলে কি খেতে হবে?
উত্তর: ডেঙ্গু জ্বর হলে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পরিমাণে তরল গ্রহণ করা উচিত: জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল, ফলের রস (যেমন কমলা, পেঁপে, ডালিম), স্যুপ, এবং লিকুইড বা নরম খাবার যেমন ভাত, ডাল, খিচুড়ি, সেদ্ধ সবজি ইত্যাদি খেতে হবে। সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার খুব জরুরি।