চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয়

Chikungunya: চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয়

Share This Post

বর্ষাকাল এলেই আমাদের মনে যে রোগের আশঙ্কা দেখা দেয়, তার মধ্যে ডেঙ্গুর পাশাপাশি চিকুনগুনিয়াও অন্যতম। এটি একটি মশাবাহিত রোগ, যা তীব্র জ্বর এবং অসহনীয় গাঁটে ব্যথা নিয়ে আসে। যদিও এটি সাধারণত ডেঙ্গুর মতো জীবনঘাতী নয়, তবে এর উপসর্গগুলো, বিশেষ করে দীর্ঘস্থায়ী গাঁটে ব্যথা, মানুষের দৈনন্দিন জীবনকে মারাত্মকভাবে ব্যাহত করতে পারে। ডেঙ্গুর মতোই চিকুনগুনিয়ার কোনো নির্দিষ্ট ঔষধ নেই, তাই এর প্রতিরোধই হলো সবচেয়ে কার্যকর উপায়। আমাদের আশেপাশে এই রোগের জীবাণুবাহী মশা লুকিয়ে থাকে, তাই এর সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান রাখা এবং প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া অত্যন্ত জরুরি। এই প্রবন্ধে আমরা চিকুনগুনিয়া কী ধরনের রোগ, এর কারণ, লক্ষণ, ডেঙ্গুর সাথে এর পার্থক্য, প্রতিকার এবং প্রতিরোধের জন্য আপনার করণীয় বিষয়গুলো নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।


চিকুনগুনিয়া কী ধরনের রোগ?

Chikungunya হলো একটি ভাইরাল সংক্রমণ, যা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) দ্বারা সৃষ্ট হয়। এটি একটি “আর্বোভাইরাস” (arthropod-borne virus), যার অর্থ হলো এটি মূলত পোকামাকড়, যেমন মশার মাধ্যমে ছড়ায়। এই ভাইরাসটি মানুষের মধ্যে অসুস্থতা সৃষ্টি করে, যার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তীব্র জ্বর এবং অসহনীয় গাঁটে ব্যথা। এই রোগটি সাধারণত মারাত্মক আকার ধারণ করে না বা প্রাণঘাতী হয় না, তবে এর সবচেয়ে কষ্টদায়ক দিক হলো গাঁটের ব্যথা, যা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি কিছু ক্ষেত্রে কয়েক বছর পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। এই দীর্ঘস্থায়ী ব্যথার কারণে রোগী স্বাভাবিক কাজকর্মে ফিরে যেতে অনেক সময় সমস্যা অনুভব করেন।


চিকুনগুনিয়া রোগের কারণ ও কোন মশার কামড়ে হয়?

চিকুনগুনিয়া রোগের প্রধান কারণ হলো চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV)। এই ভাইরাসটি মূলত এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) এবং এডিস অ্যালবোপিক্টাস (Aedes albopictus) নামক দুই প্রজাতির মশার কামড়ের মাধ্যমে মানুষে ছড়ায়। চিকুনগুনিয়া কোন মশার কামড়ে হয়? এই দুটি মশাকে “টাইগার মশা”ও বলা হয় কারণ এদের গায়ে ডোরাকাটা দাগ থাকে।

ভাইরাস ছড়ানোর পদ্ধতি:

  1. যখন একটি সুস্থ এডিস মশা চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়, তখন মশার শরীরে ভাইরাস প্রবেশ করে এবং বংশবৃদ্ধি করে।
  2. এরপর সেই ভাইরাস বহনকারী মশাটি যখন অন্য কোনো সুস্থ মানুষকে কামড়ায়, তখন মশার লালার মাধ্যমে ভাইরাস সুস্থ ব্যক্তির রক্তে প্রবেশ করে এবং তাকে আক্রান্ত করে।

এই মশাগুলো সাধারণত দিনের বেলায় বেশি কামড়ায়, বিশেষ করে সকাল এবং সন্ধ্যার সময়। এরা পরিষ্কার, স্থির জলে ডিম পাড়ে, যেমন – ফুলের টব, টায়ার, বালতি বা অন্যান্য পাত্রে জমে থাকা জল


চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ :

চিকুনগুনিয়া ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার সাধারণত ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে এর লক্ষণগুলো প্রকাশ পায়, যদিও কিছু ক্ষেত্রে এটি ২ থেকে ১২ দিন পর্যন্ত সময় নিতে পারে। চিকুনগুনিয়া রোগের লক্ষণ ও প্রতিকার সম্পর্কে জানা থাকলে রোগটি দ্রুত মোকাবিলা করা সহজ হয়।

চিকুনগুনিয়া জ্বরের প্রাথমিক লক্ষণগুলি হলো:

  1. হঠাৎ তীব্র জ্বর: এটি চিকুনগুনিয়ার একটি প্রধান লক্ষণ। জ্বর হঠাৎ করে আসে এবং তা ১০২ থেকে ১০৪ ডিগ্রি ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। এই জ্বর ২ থেকে ৭ দিন পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে।
  2. অসহনীয় গাঁটে ব্যথা: এটি চিকুনগুনিয়ার সবচেয়ে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এবং কষ্টদায়ক লক্ষণ। শরীরের ছোট-বড় বিভিন্ন গাঁটে, যেমন – হাত, পা, কব্জি, গোড়ালি, আঙুল, হাঁটু, কোমর বা কাঁধে তীব্র ব্যথা হয়। এই ব্যথা এতটাই তীব্র হতে পারে যে রোগী হাঁটতে বা নড়াচড়া করতেও কষ্ট অনুভব করেন। এই ব্যথা কয়েক সপ্তাহ, মাস এমনকি কিছু ক্ষেত্রে বছরব্যাপী স্থায়ী হতে পারে।
  3. মাথাব্যথা: তীব্র মাথাব্যথা একটি সাধারণ উপসর্গ।
  4. মাংসপেশীতে ব্যথা: শরীরের মাংসপেশীতেও ব্যথা অনুভূত হতে পারে।
  5. র‍্যাশ বা ফুসকুড়ি: জ্বরের কয়েক দিনের মধ্যে শরীরে লালচে ফুসকুড়ি বা র‍্যাশ দেখা দিতে পারে, যা প্রথমে বুক ও মুখ থেকে শুরু হয়ে পরে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে।
  6. ক্লান্তি ও দুর্বলতা: রোগী অতিরিক্ত দুর্বলতা এবং ক্লান্তি অনুভব করেন।
  7. বমি বমি ভাব বা বমি: কিছু রোগীর বমি বমি ভাব হতে পারে বা বমি হতে পারে।
  8. চোখে ব্যথা: চোখের পেছনে ব্যথা অনুভূত হতে পারে।

এই লক্ষণগুলো দেখা দিলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া উচিত।


ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া পার্থক্য:

ডেঙ্গু এবং চিকুনগুনিয়া উভয়ই এডিস মশার কামড়ে হয় এবং এদের প্রাথমিক লক্ষণগুলোতে বেশ মিল রয়েছে, তাই রোগ নির্ণয়ে ভুল হতে পারে। তবে কিছু নির্দিষ্ট পার্থক্য রয়েছে:

বৈশিষ্টডেঙ্গু জ্বরচিকুনগুনিয়া জ্বর
ভাইরাসডেঙ্গু ভাইরাস (DENV)চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV)
মূল পার্থক্যসাধারণত তীব্র রক্তপাত এবং শক হওয়ার ঝুঁকি বেশি। প্লেটলেট সংখ্যা মারাত্মকভাবে কমে যায়।তীব্র ও দীর্ঘস্থায়ী গাঁটে ব্যথা (আর্থ্রাইটিস)। রক্তপাত বিরল।
জ্বরউচ্চ জ্বর (১০২-১০৫°ফা), প্রায়শই ‘স্যাডলব্যাক’ প্যাটার্ন (জ্বর কমে আবার বাড়ে)।উচ্চ জ্বর (১০২-১০৪°ফা), সাধারণত একটানা থাকে।
গাঁটে ব্যথামাংসপেশী ও গাঁটে ব্যথা হয়, তবে চিকুনগুনিয়ার মতো তীব্র বা দীর্ঘস্থায়ী নয়।অত্যন্ত তীব্র ও অসহনীয় গাঁটে ব্যথা, যা কয়েক মাস বা বছর ধরেও থাকতে পারে।
র‍্যাশজ্বর কমার পর বা জ্বরের সময় শরীরে র‍্যাশ দেখা দেয়।জ্বরের ২-৫ দিনের মধ্যে র‍্যাশ দেখা দেয়।
রক্তক্ষরণনাক, দাঁতের মাড়ি, মল বা ত্বকের নিচে রক্তক্ষরণ (হেমোরেজিক ফিভার) হওয়ার ঝুঁকি বেশি।রক্তক্ষরণ বিরল বা খুবই হালকা প্রকৃতির হয়।
মৃত্যু ঝুঁকিগুরুতর ডেঙ্গু (DHF/DSS) হলে মৃত্যু ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি।মৃত্যু ঝুঁকি অত্যন্ত কম, যদিও রোগটি খুবই কষ্টদায়ক হতে পারে।
ক্লান্তিতীব্র ক্লান্তি ও দুর্বলতা।ক্লান্তি ও দুর্বলতা, সাথে গাঁটে ব্যথা।
শক সিনড্রোমডেঙ্গু শক সিনড্রোম (DSS) হতে পারে।শক সিনড্রোম সাধারণত হয় না।

চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয়

চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধের মূল চাবিকাঠি হলো মশার কামড় এড়ানো এবং মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা। যেহেতু এর কোনো নির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই, তাই প্রতিরোধই সবচেয়ে জরুরি।

  1. মশার বংশবৃদ্ধি রোধ (পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা):
    • জল জমা বন্ধ করুন: এডিস মশা পরিষ্কার, জমে থাকা জলে ডিম পাড়ে। তাই আপনার বাড়ি এবং তার আশেপাশে কোথাও যেন জল জমে না থাকে সেদিকে কঠোর নজর রাখুন। ফুলের টব, টায়ার, ভাঙা বালতি, পুরনো কন্টেইনার, এয়ার কুলারের জল, বা ছাদের খোলা জায়গায় জমে থাকা জল নিয়মিত (অন্তত সপ্তাহে একবার) ফেলে দিন বা শুকিয়ে নিন।
    • কন্টেইনার ঢেকে রাখুন: জল ধরে রাখা হয় এমন পাত্র, যেমন জলের ট্যাঙ্ক, বালতি ইত্যাদি ভালোভাবে ঢেকে রাখুন যাতে মশা ডিম পাড়তে না পারে।
    • পরিষ্কার রাখুন: বাড়ির আশেপাশে থাকা ড্রেন বা নর্দমাগুলো পরিষ্কার রাখুন যাতে জল জমে না থাকে। ঝোপঝাড় কেটে ফেলুন, কারণ মশা সেখানে আশ্রয় নিতে পারে।
  2. ব্যক্তিগত সুরক্ষা:
    • মশা তাড়ানোর লোশন/স্প্রে: দিনের বেলা বা সন্ধ্যায় বাইরে গেলে DEET, পিক্যারিডিন বা ইউক্যালিপটাস তেল যুক্ত মশা তাড়ানোর লোশন বা স্প্রে ব্যবহার করুন। শিশুদের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপাদানযুক্ত লোশন ব্যবহার করা ভালো।
    • সঠিক পোশাক পরা: দিনের বেলাতেও বাইরে গেলে লম্বা হাতাযুক্ত পোশাক এবং ফুলপ্যান্ট পরুন, যাতে শরীরের বেশিরভাগ অংশ ঢাকা থাকে। হালকা রঙের পোশাক পরুন, কারণ গাঢ় রঙ মশা আকর্ষণ করতে পারে।
    • মশারির ব্যবহার: দিনের বেলায় ঘুমালে বা বিশ্রাম নিলে মশারি ব্যবহার করুন। যদি আপনার এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি হয়, তবে কীটনাশকযুক্ত মশারি ব্যবহার করা যেতে পারে।
  3. বাড়িতে মশা প্রবেশ রোধ:
    • জানালা ও দরজায় নেট: মশা ঘরে প্রবেশ আটকাতে জানালা ও দরজায় মশারোধী নেট বা জালি লাগান।
    • কয়েল/ধূপ/স্প্রে: মশা তাড়ানোর জন্য কয়েল, ম্যাট বা স্প্রে ব্যবহার করতে পারেন। তবে, এগুলো ব্যবহারের সময় ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচল নিশ্চিত করুন এবং বাচ্চাদের থেকে দূরে রাখুন।
    • সন্ধ্যায় দরজা-জানালা বন্ধ: সন্ধ্যা হওয়ার আগে এবং ভোরে সব জানালা-দরজা বন্ধ করে রাখুন, কারণ এই সময়গুলোতে মশা বেশি সক্রিয় থাকে।
  4. সচেতনতা বৃদ্ধি:
    • পরিবারের সদস্যদের সচেতন করুন: আপনার পরিবারের সকল সদস্যকে চিকুনগুনিয়া প্রতিরোধে করণীয় সম্পর্কে জানান এবং তাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করুন।
    • প্রতিবেশীদের সাথে কাজ করুন: আপনার এলাকার অন্যান্য বাসিন্দাদের সাথে নিয়ে মশা নিধনে এবং পরিবেশ পরিষ্কার রাখতে কাজ করুন। এটি একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

চিকুনগুনিয়া রোগের প্রতিকার ও চিকিৎসা :

চিকুনগুনিয়া একটি ভাইরাসঘটিত রোগ হওয়ায় এর কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ নেই যা ভাইরাসকে মেরে ফেলে। চিকুনগুনিয়া রোগের প্রতিকার মূলত লক্ষণভিত্তিক এবং শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করার ওপর নির্ভর করে।

  1. ডাক্তারের পরামর্শ: চিকুনগুনিয়ার লক্ষণ দেখা দিলেই দেরি না করে অবিলম্বে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিজে নিজে ঔষধ না খেয়ে ডাক্তারের নির্দেশ মেনে চলুন।
  2. ব্যথানাশক ঔষধ: জ্বরের জন্য প্যারাসিটামল ঔষধ ব্যবহার করা হয়। এটি জ্বর এবং গাঁটের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। তবে, অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন বা ডাইক্লোফেনাক-এর মতো নন-স্টেরয়েডাল অ্যান্টি-ইনফ্ল্যামেটরি ড্রাগস (NSAIDs) ব্যবহার করা উচিত নয়, কারণ এগুলো রক্তক্ষরণের ঝুঁকি বাড়ায় এবং ডেঙ্গুর সাথে যদি সহ-সংক্রমণ থাকে, তবে তা মারাত্মক হতে পারে।
  3. পর্যাপ্ত বিশ্রাম: শরীরকে সুস্থ হতে পর্যাপ্ত বিশ্রাম দেওয়া খুবই জরুরি। অতিরিক্ত পরিশ্রম এড়িয়ে চলুন।
  4. পর্যাপ্ত তরল গ্রহণ: পানিশূন্যতা এড়াতে প্রচুর পরিমাণে তরল পানীয় গ্রহণ করুন। জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল, ফলের রস (যেমন কমলা, পেঁপে, ডালিম), স্যুপ ইত্যাদি পান করুন। এটি শরীরকে হাইড্রেটেড রাখবে এবং দ্রুত সুস্থ হতে সাহায্য করবে।
  5. গাঁটের ব্যথা ব্যবস্থাপনা: চিকুনগুনিয়ার দীর্ঘস্থায়ী গাঁটের ব্যথা কমানোর জন্য কিছু ক্ষেত্রে ফিজিওথেরাপি, হালকা ব্যায়াম বা ঠান্ডা-গরম সেঁক নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। কিছু নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে ডাক্তার জয়েন্টের প্রদাহ কমানোর জন্য ঔষধ দিতে পারেন, তবে তা অবশ্যই ডাক্তারের নির্দেশনায়।

চিকুনগুনিয়া রোগের টেস্ট :

চিকুনগুনিয়া নিশ্চিত করার জন্য সাধারণত কিছু রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এই পরীক্ষাগুলো ডেঙ্গু বা অন্যান্য ভাইরাস থেকে চিকুনগুনিয়াকে আলাদা করতে সাহায্য করে।

  1. আরটি-পিসিআর (RT-PCR): এই পরীক্ষাটি রোগের প্রাথমিক পর্যায়ে (সাধারণত লক্ষণ প্রকাশের প্রথম সপ্তাহে) করা হয়। এটি রক্তে ভাইরাসের জিনগত উপাদান সনাক্ত করে এবং খুব দ্রুত ও নিশ্চিতভাবে রোগ নির্ণয় করতে পারে।
  2. সেরোলজিক্যাল টেস্ট (Serological Tests – IgM/IgG Antibody Test): এই পরীক্ষাগুলো রক্তে ভাইরাসের বিরুদ্ধে তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি (IgM এবং IgG) সনাক্ত করে। IgM অ্যান্টিবডি সাধারণত লক্ষণ প্রকাশের ৪-৭ দিনের মধ্যে তৈরি হয় এবং IgG অ্যান্টিবডি রোগ সেরে যাওয়ার পর দীর্ঘ সময় ধরে শরীরে থাকে। এই পরীক্ষাগুলো রোগের পরবর্তী পর্যায়ে বা পূর্বে সংক্রমণ হয়েছিল কিনা তা জানার জন্য ব্যবহার করা হয়।

চিকুনগুনিয়া রোগের খাবার :

চিকুনগুনিয়া রোগের সময় শরীর খুব দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এই সময় সঠিক খাদ্যাভ্যাস রোগীকে দ্রুত সুস্থ হতে এবং রোগের সাথে লড়াই করতে সাহায্য করে।

  1. পর্যাপ্ত তরল: শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন। ORS, ডাবের জল, ফলের রস (যেমন কমলা, পেঁপে, ডালিম), বিভিন্ন সবজির স্যুপ বা চিকেন স্যুপ পান করুন।
  2. সহজপাচ্য ও পুষ্টিকর খাবার: নরম ভাত, সুজি, পাতলা ডাল, খিচুড়ি, সেদ্ধ সবজি (যেমন লাউ, কুমড়ো, পেঁপে), মুরগির মাংসের পাতলা ঝোল, বা সেদ্ধ ডিম গ্রহণ করুন। তেল-মসলাযুক্ত, ভাজা-পোড়া খাবার, এবং ফাস্ট ফুড এড়িয়ে চলুন।
  3. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী খাবার: ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল (যেমন কমলা, আমলকি, পেয়ারা, কিউই), ভিটামিন ই সমৃদ্ধ খাবার (বাদাম, বীজ), এবং জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার (ডাল, শস্য) খাদ্যতালিকায় রাখুন।
  4. প্রদাহরোধী খাবার: আদা, হলুদ, এবং রসুনকে তাদের প্রদাহরোধী গুণের জন্য পরিচিত। এগুলো স্যুপ বা তরকারিতে ব্যবহার করা যেতে পারে।
  5. ডালিমের রস: এটি প্লেটলেট বাড়াতে সহায়ক বলে মনে করা হয় এবং এটি শরীরে আয়রন সরবরাহ করে দুর্বলতা কাটাতে সাহায্য করে।
  6. পেঁপে পাতার রস: কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে, পেঁপে পাতার রস প্লেটলেট বাড়াতে এবং ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া উভয় ক্ষেত্রেই উপকার করতে পারে। ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে এটি পান করা যেতে পারে।

উপসংহার

চিকুনগুনিয়া জ্বর একটি কষ্টদায়ক রোগ যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত করতে পারে। তবে, সঠিক জ্ঞান এবং সচেতনতা দিয়ে আমরা এই রোগকে প্রতিরোধ করতে পারি। মশার বংশবৃদ্ধি রোধ করা, মশার কামড় থেকে নিজেকে সুরক্ষিত রাখা, এবং অসুস্থ হলে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া – এই তিনটি বিষয় চিকুনগুনিয়ার বিরুদ্ধে আমাদের প্রধান হাতিয়ার। আপনার পরিবার এবং সম্প্রদায়কে সুরক্ষিত রাখতে মশা নিধনে এগিয়ে আসুন এবং সুস্থ জীবনযাপন করুন। মনে রাখবেন, প্রতিরোধ সর্বদা চিকিৎসার চেয়ে উত্তম।


প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী (FAQs)

প্রশ্ন ১: ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার মূল পার্থক্য কী?

উত্তর: ডেঙ্গুতে সাধারণত তীব্র রক্তপাত এবং প্লেটলেট কমে যাওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে, যা জীবনঘাতী হতে পারে। অন্যদিকে, চিকুনগুনিয়ার প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো অসহনীয় এবং দীর্ঘস্থায়ী গাঁটে ব্যথা, যদিও এতে রক্তপাতের ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে কম এবং এটি সাধারণত প্রাণঘাতী নয়।

প্রশ্ন ২: চিকুনগুনিয়া রোগের প্রতিকার কী?

উত্তর: চিকুনগুনিয়া রোগের কোনো নির্দিষ্ট অ্যান্টিভাইরাল ঔষধ নেই। প্রতিকার মূলত লক্ষণভিত্তিক। জ্বর ও ব্যথা কমানোর জন্য প্যারাসিটামল, প্রচুর বিশ্রাম, এবং শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে পর্যাপ্ত তরল (যেমন জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল) পান করা উচিত। কোনো ব্যথানাশক (যেমন অ্যাসপিরিন, আইবুপ্রোফেন) ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া খাওয়া উচিত নয়।

প্রশ্ন ৩: চিকুনগুনিয়া কি ধরনের রোগ?

উত্তর: চিকুনগুনিয়া হলো একটি ভাইরাল সংক্রমণ যা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস (CHIKV) দ্বারা সৃষ্ট হয়। এটি এডিস মশার কামড়ের মাধ্যমে ছড়ায় এবং এর প্রধান লক্ষণ হলো তীব্র জ্বর ও অসহনীয় গাঁটে ব্যথা।

প্রশ্ন ৪: চিকুনগুনিয়া রোগের টেস্ট কী?

উত্তর: চিকুনগুনিয়া রোগ নির্ণয়ের জন্য সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে RT-PCR (লক্ষণ প্রকাশের প্রথম সপ্তাহে ভাইরাস সনাক্তকরণের জন্য) এবং সেরোলজিক্যাল টেস্ট (IgM/IgG অ্যান্টিবডি সনাক্তকরণের জন্য, যা রোগের পরবর্তী পর্যায়ে করা হয়)।

প্রশ্ন ৫: চিকুনগুনিয়া কোন মশার কামড়ে হয়?

উত্তর: চিকুনগুনিয়া এডিস ইজিপ্টি (Aedes aegypti) এবং এডিস অ্যালবোপিক্টাস (Aedes albopictus) নামক মশার কামড়ে হয়। এই মশাগুলো দিনের বেলা বেশি সক্রিয় থাকে।

প্রশ্ন ৬: চিকুনগুনিয়া রোগের খাবার কী?

উত্তর: চিকুনগুনিয়া রোগের সময় প্রচুর পরিমাণে তরল (যেমন জল, ওরস্যালাইন, ডাবের জল, ফলের রস, স্যুপ) পান করা উচিত। সহজপাচ্য এবং পুষ্টিকর খাবার যেমন নরম ভাত, ডাল, সেদ্ধ সবজি, চিকেন স্যুপ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী ফল (যেমন কমলা, পেঁপে, ডালিম) খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।



Share This Post

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।