diabetes-khabar-niyom-bangla

ডায়াবেটিসে কী খাবেন ও কী খাবেন না ?

Share This Post

ডায়াবেটিস একটি জটিল রোগ যা আপনার খাদ্যতালিকা নিয়ন্ত্রণে রাখার উপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। সঠিক খাবার গ্রহণ করে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং সুস্থ জীবনযাপন করা সম্ভব। এই আর্টিকেলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য উপযুক্ত খাবার এবং যা এড়িয়ে চলা উচিত সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

Table of Contents

ডায়াবেটিসে যা খাবেন:

১. সম্পূর্ণ শস্য (Whole Grains):

সাদা চাল বা পরিশোধিত আটার পরিবর্তে ব্রাউন রাইস, ওটস, চিড়া, রাগি, জোয়ারের মতো খাবার রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণকে সহজ করে। এগুলোতে উচ্চ ফাইবার ধীরে ধীরে হজম হয়, ফলে গ্লুকোজের মাত্রা হঠাৎ বৃদ্ধি পায় না।

  • টিপস: সকালের নাস্তায় ওটস বা চিড়া, দুপুরে ব্রাউন রাইস বা রাগি-রুটি এবং একসাথে বেশি পরিমাণে না খেয়ে ভাগ করে খান।

২. সবজি (Vegetables):

সবুজ শাক-সবজি, করলা, লাউ, কুমড়া, মিষ্টি কুমড়া, ফুলকপি, বাঁধাকপি, গাজরের মতো সবজি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এগুলোতে ক্যালোরি কম এবং ফাইবার, ভিটামিন ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট প্রচুর পরিমাণে থাকে।

  • টিপস: প্রতিদিন অন্তত দুই বেলা সবজি রাখুন, করলা ভাজি বা ঝোল এবং গাজর বা বাঁধাকপি সালাদ হিসেবে গ্রহণ করুন।

৩. ফল (Fruits):

আপেল, পেয়ারা, জাম, বেরি, কমলা, আমলকির মতো কম শর্করাযুক্ত এবং ফাইবার সমৃদ্ধ ফল ডায়াবেটিসে মাঝে মাঝে খাওয়া যেতে পারে। তবে কাঁঠাল, চিংড়ি আম, আঙুরের মতো মিষ্টি ফল পরিমাণে কম খাওয়া উচিত।

  • টিপস: ফল দুপুরে বা বিকালের নাস্তায় খান, জুসের পরিবর্তে গোটা ফল গ্রহণ করুন এবং একবারে বেশি না খেয়ে ভাগ করে খান।

৪. প্রোটিন (Protein):

ডাল, ছোলা, মসুর, ডিমের সাদা অংশ, মাছ, মুরগি (চর্বি ছাড়া), সয়াবিন রক্তে চিনি না বাড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে এবং শরীরের মাংসপেশি ঠিক রাখে

  • টিপস: প্রতিদিনের এক বেলায় ভেজ বা নন-ভেজ প্রোটিন রাখুন, ডিমের শুধু সাদা অংশ খান এবং মাংসের চর্বি বাদ দিয়ে সেদ্ধ বা গ্রিল করে রান্না করুন।

৫. স্বাস্থ্যকর ফ্যাটস (Healthy Fats):

বাদাম, চিয়া সিডস, ফ্ল্যাক্স সিডস (তিসি), অলিভ অয়েল শরীরে ভালো চর্বি সরবরাহ করে এবং ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়াতে সাহায্য করে। তবে পরিমাণে সীমিত রাখা জরুরি।

  • টিপস: দিনে ৫-৬টি বাদাম, ১-২ চা চামচ চিয়া বা ফ্ল্যাক্স সিডস এবং সালাদে অলিভ অয়েল ব্যবহার করুন।

ডায়াবেটিসে যা খাবেন না:

১. চিনি ও চিনিযুক্ত খাবার:

চা-কফিতে চিনি, মিষ্টি, কেক, কুকিজ, কোমল পানীয় রক্তে শর্করার মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি করে এবং ওজন ও ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স বাড়ায়।

  • টিপস: চা-কফিতে স্টেভিয়া বা সুগার-ফ্রি ব্যবহার করুন এবং চিনিযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।

২. সাদা চাল ও ময়দা:

সাদা চাল, ময়দা, লুচি, পরোটা দ্রুত হজম হয়ে গ্লুকোজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। এর পরিবর্তে ব্রাউন রাইস, লাল আটা, ওটস ব্যবহার করুন।

  • টিপস: জলখাবারে বা ভাতে ফাইবারযুক্ত শস্য যোগ করুন এবং খালি পেটে চিনিযুক্ত খাবার খাবেন না।

৩. ফাস্ট ফুড ও প্রক্রিয়াজাত খাবার (Processed Food):

চিপস, বার্গার, ফ্রাইড খাবার, প্যাকেট স্যুপ, ইনস্ট্যান্ট নুডলস রক্তে শর্করা, কোলেস্টেরল ও ওজন বাড়িয়ে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়।

  • টিপস: ক্ষুধা লাগলে ঘরে তৈরি স্বাস্থ্যকর স্ন্যাকস খান এবং বাইরে খাওয়ার আগে খাবারের উপাদান দেখে নিন।

৪. হাই ক্যালোরি ফল ও শুকনো ফল:

খেজুর, কিশমিশ, চিনি দেওয়া শুকনো আম রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দ্রুত বাড়িয়ে দেয়, বিশেষ করে খালি পেটে খেলে।

  • টিপস: খেজুর বা কিশমিশ দিনে ১-২টির বেশি নয় এবং চিনি দেওয়া শুকনো ফল এড়িয়ে চলুন।

ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ও ডায়াবেটিস:

ইনসুলিন বা ওষুধ গ্রহণকারী ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য ইন্টারমিটেন্ট ফাস্টিং ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। এটি শুরু করার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। তবে রাতে ৮টার পর না খাওয়া এবং সকাল ৮টায় ব্রেকফাস্ট করার মতো হালকা নিয়ম অনুসরণ করা যেতে পারে।

সহজ টিপস:

  • দিনে ৫-৬ বার অল্প পরিমাণে খাবার গ্রহণ করুন।
  • প্লেটের অর্ধেক সবজি দিয়ে পূর্ণ করুন।
  • ফাইবারযুক্ত খাবার বেশি খান।
  • প্রচুর পরিমাণে জল পান করুন।
  • মিষ্টি ফল কম খান, তবে একেবারে বাদ দেবেন না।
  • প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ে খাবার গ্রহণ করুন।

ডায়াবেটিসের ডায়েট মানে কম খাওয়া নয়, বরং সঠিকভাবে এবং বুঝেশুনে খাবার গ্রহণ করা।

Diet chart for weight loss
Diet chart for weight loss

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে করণীয়:

ডায়াবেটিস একবার শরীরে বাসা বাঁধলে তা সারাজীবনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়ায়। তবে কিছু সহজ অভ্যাস রপ্ত করার মাধ্যমে এই রোগ প্রতিরোধের সম্ভাবনা বহুলাংশে বৃদ্ধি করা যায়। আসুন, ডায়াবেটিস প্রতিরোধে চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিস্তারিতভাবে জেনে নেওয়া যাক:

১. ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা: সুস্থ জীবনের চাবিকাঠি

শরীরের অতিরিক্ত ওজন, বিশেষত পেটের মেদ, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম। অতিরিক্ত চর্বি কোষগুলো ইনসুলিনের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়, যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেড়ে যায়। তাই, সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য সঠিক ওজন নিয়ন্ত্রণ করা অপরিহার্য। আকস্মিক কঠোর ডায়েটের পরিবর্তে ধীরে ধীরে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনাই বুদ্ধিমানের কাজ।

  • কার্যকর টিপস:
    • নিয়মিতভাবে হাঁটা: প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট দ্রুত হাঁটলে ক্যালোরি ঝরে এবং শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সক্রিয় থাকে। কাজের পথে হেঁটে যাওয়া বা লিফটের বদলে সিঁড়ি ব্যবহার করাও এক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে।
    • স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন: চিনিযুক্ত খাবার (যেমন মিষ্টি পানীয়, ডেজার্ট), প্রক্রিয়াজাত খাবার এবং অতিরিক্ত ফ্যাটযুক্ত খাবার ত্যাগ করে ফল, সবজি, শস্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করুন। ফাইবারযুক্ত খাবার দীর্ঘক্ষণ পেট ভরা রাখে এবং রক্তে শর্করার হঠাৎ বৃদ্ধি রোধ করে।

২. নিয়মিত হাঁটা ও ব্যায়াম: শরীরকে রাখুন সচল

শারীরিক কার্যকলাপ শুধু ওজন কমাতেই সাহায্য করে না, এটি ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা বাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত ব্যায়াম রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। জিমে যাওয়ার প্রয়োজন নেই, প্রতিদিনের কিছু সাধারণ কার্যকলাপও যথেষ্ট উপকারী হতে পারে।

  • কার্যকর টিপস:
    • দৈনিক হাঁটার অভ্যাস: প্রতিদিন অন্তত দুইবার ১৫ মিনিট করে হাঁটলে আপনার শরীরের রক্ত সঞ্চালন উন্নত হবে এবং গ্লুকোজের ব্যবহার বাড়বে।
    • অন্যান্য ব্যায়াম: হাঁটার পাশাপাশি সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা, যোগা বা হালকা অ্যারোবিক্সের মতো ব্যায়ামও আপনার শরীরের জন্য খুবই উপকারী। নিজের পছন্দ অনুযায়ী যেকোনো একটি ব্যায়াম বেছে নিয়ে নিয়মিত করার চেষ্টা করুন।

৩. স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস: সঠিক পুষ্টির গ্রহণ

আপনার খাদ্যতালিকা ডায়াবেটিস প্রতিরোধের একটি শক্তিশালী হাতিয়ার। অস্বাস্থ্যকর খাবার ত্যাগ করে পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করাই মূল লক্ষ্য। মনে রাখবেন, আপনি যা খাচ্ছেন, তার সরাসরি প্রভাব আপনার শরীরের উপর পড়ছে।

  • কার্যকর টিপস:
    • প্লেটের নিয়ম: প্রতিদিনের খাবারে খেয়াল রাখুন যেন আপনার প্লেটের অর্ধেক থাকে বিভিন্ন ধরনের রঙিন সবজি (যেমন পালং শাক, গাজর, ব্রকলি), এক চতুর্থাংশ প্রোটিন (যেমন ডাল, ডিমের সাদা অংশ, মাছ) এবং বাকি এক চতুর্থাংশ স্বাস্থ্যকর শর্করা (যেমন ব্রাউন রাইস, ওটস)।
    • জাঙ্ক ফুড পরিহার: ফাস্ট ফুড, ভাজা খাবার এবং অতিরিক্ত মিষ্টি খাবার ত্যাগ করুন। এগুলোতে উচ্চ পরিমাণে ক্যালোরি, ফ্যাট এবং চিনি থাকে যা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
    • প্রচুর ফল ও সবজি: প্রতিদিন বিভিন্ন ধরনের ফল ও সবজি খান। এগুলোতে ভিটামিন, খনিজ এবং ফাইবার থাকে যা আপনার শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।

৪. স্ট্রেস কমানো: সুস্থ মনের জন্য অপরিহার্য

মানসিক চাপ বা স্ট্রেস শরীরের হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করে, যার ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যেতে পারে। তাই ডায়াবেটিস প্রতিরোধে মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণ করা অত্যন্ত জরুরি।

  • কার্যকর টিপস:
    • নিয়মিত শ্বাস-প্রশ্বাসের ব্যায়াম: রাতে ঘুমানোর আগে ৫ মিনিট গভীর শ্বাস নেওয়ার ব্যায়াম করলে মন শান্ত হয় এবং ঘুম ভালো হয়।
    • প্রকৃতির সান্নিধ্যে সময় কাটানো: প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ প্রকৃতির মাঝে হাঁটলে মন সতেজ থাকে এবং স্ট্রেস কমে।
    • পছন্দের কাজ করা: গান শোনা, বই পড়া বা অন্য যেকোনো পছন্দের কাজ করার মাধ্যমে মনকে আনন্দিত রাখা যায়, যা স্ট্রেস কমাতে সাহায্য করে।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধের জন্য কোনো কঠিন নিয়ম পালনের প্রয়োজন নেই, বরং ছোট ছোট স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলাই যথেষ্ট। একটু সচেতনতা এবং সঠিক জীবনযাপন আপনাকে এই রোগ থেকে দূরে রাখতে পারে। মনে রাখবেন, সুস্থ জীবন আপনার অধিকার এবং এর জন্য আজ থেকেই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত।

শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডায়াবেটিস নির্দেশিকা:

গর্ভাবস্থায় জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস এবং শিশুদের টাইপ ১ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন। নিয়মিত ব্লাড সুগার পরীক্ষা, ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ডায়েট ও ব্যায়াম এবং প্রয়োজনে ইনসুলিন গ্রহণ জরুরি। অভিভাবকদের উচিত শিশুদের মানসিক সাপোর্ট দেওয়া এবং তাদের খাদ্য ও ব্যায়ামের বিষয়ে সচেতন থাকা।

মানুষের জিজ্ঞাসা ও সমাধান || ডায়াবেটিস নিয়ে কিছু জরুরি প্রশ্নের উত্তর :

ডায়াবেটিস একটি বহুল পরিচিত রোগ এবং এ সম্পর্কে মানুষের মনে নানান প্রশ্ন জাগে। এখানে কিছু সাধারণ জিজ্ঞাসার বিস্তারিত উত্তর দেওয়া হলো, যা আপনাকে এই রোগ সম্পর্কে আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করবে:

প্রশ্ন ১: ডায়াবেটিস কি সম্পূর্ণরূপে নিরাময়যোগ্য?

উত্তর: ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে নিরাময়ের বিষয়টি নির্ভর করে এর প্রকারের উপর।

  • টাইপ ১ ডায়াবেটিস: এই ধরনের ডায়াবেটিসে অগ্ন্যাশয় (Pancreas) পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না, কারণ শরীরের নিজস্ব রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভুলবশত অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষগুলোকে ধ্বংস করে ফেলে। বর্তমানে, টাইপ ১ ডায়াবেটিস সম্পূর্ণরূপে নিরাময় করা সম্ভব নয়। এই অবস্থায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে বেঁচে থাকার জন্য নিয়মিত ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্পের উপর নির্ভর করতে হয়। তবে, আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং জীবনযাত্রার সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এই রোগটিকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং একজন ব্যক্তি স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারে।
  • টাইপ ২ ডায়াবেটিস: টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে শরীর হয় পর্যাপ্ত পরিমাণে ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না (ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স), অথবা অগ্ন্যাশয় যথেষ্ট পরিমাণে ইনসুলিন উৎপাদন করতে পারে না। এই প্রকার ডায়াবেটিস অনেক সময় জীবনযাত্রার পরিবর্তন, যেমন স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস গ্রহণ, নিয়মিত ব্যায়াম এবং ওজন কমানোর মাধ্যমে উল্লেখযোগ্যভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে। কিছু ক্ষেত্রে, সঠিক জীবনযাপন পদ্ধতির মাধ্যমে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিকের কাছাকাছি নিয়ে আসা সম্ভব, যাকে “রোগের উপশম” (Remission) বলা হয়। তবে, এটিকে সম্পূর্ণরূপে “সেরে যাওয়া” বলা যায় না, কারণ রোগের পুনরায় ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। নিয়মিত পর্যবেক্ষণ এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা বজায় রাখা এক্ষেত্রেও জরুরি।

প্রশ্ন ২: ডায়াবেটিস রোগীদের দিনে কতবার রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত?

উত্তর: রক্তে শর্করার মাত্রা কতবার পরীক্ষা করতে হবে তা ব্যক্তির ডায়াবেটিসের ধরন, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং শারীরিক অবস্থার উপর নির্ভরশীল। এর কোনো নির্দিষ্ট সার্বজনীন নিয়ম নেই, তবে কিছু সাধারণ নির্দেশিকা নিচে দেওয়া হলো:

  • টাইপ ১ ডায়াবেটিস: যারা টাইপ ১ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং ইনসুলিন গ্রহণ করেন, তাদের সাধারণত দিনে ৩-৪ বার বা তারও বেশি রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে। এটি খাবারের আগে, খাবারের পরে, ব্যায়ামের আগে বা পরে এবং রাতে ঘুমের আগে করার পরামর্শ দেওয়া হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী এই রুটিন পরিবর্তিত হতে পারে।
  • টাইপ ২ ডায়াবেটিস: টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার পরীক্ষার ফ্রিকোয়েন্সি অনেক কম হতে পারে, বিশেষ করে যারা শুধু ডায়েট এবং ব্যায়ামের মাধ্যমে রোগ নিয়ন্ত্রণ করছেন বা মুখে খাওয়ার ওষুধ গ্রহণ করছেন। তাদের দিনে ১-২ বার অথবা সপ্তাহে কয়েকবার পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হতে পারে। তবে, যারা ইনসুলিন গ্রহণ করছেন বা নতুন কোনো ওষুধ শুরু করেছেন, তাদের ঘন ঘন রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করার প্রয়োজন হতে পারে।
  • গর্ভকালীন ডায়াবেটিস (Gestational Diabetes): গর্ভবতী মহিলাদের ক্ষেত্রে গর্ভকালীন ডায়াবেটিস ধরা পড়লে, তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা সাধারণত খাবারের আগে এবং খাবারের ১ বা ২ ঘণ্টা পরে পরীক্ষা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এই পরীক্ষার ফ্রিকোয়েন্সি চিকিৎসকের নির্দেশानुसार পরিবর্তিত হতে পারে।

সর্বোপরি, রক্তে শর্করার মাত্রা কতবার পরীক্ষা করতে হবে সে বিষয়ে আপনার ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর পরামর্শ অনুসরণ করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন ৩: ডায়াবেটিস হলে মধু খাওয়া কি নিরাপদ?

উত্তর: মধু একটি প্রাকৃতিক মিষ্টি এবং এতে কিছু পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও খনিজ উপাদান থাকে। তবে, এটি মূলত প্রাকৃতিক চিনি (ফ্রুক্টোজ এবং গ্লুকোজ) দ্বারা গঠিত। ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য মধু খাওয়ার বিষয়ে কিছু বিষয় বিবেচনা করা উচিত:

  • রক্তে শর্করার প্রভাব: মধু খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে পারে, ঠিক যেমন অন্যান্য চিনিযুক্ত খাবার খেলে বাড়ে। তাই, ডায়াবেটিস রোগীদের মধু খাওয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হবে।
  • পরিমিত পরিমাণ: যদি আপনার রক্তে শর্করার মাত্রা ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং আপনার স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী অনুমতি দেন, তাহলে খুব অল্প পরিমাণে (যেমন, এক চা চামচের কম) মধু গ্রহণ করা যেতে পারে। তবে, এটি নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করা উচিত নয়।
  • চিকিৎসকের পরামর্শ: ডায়াবেটিস রোগীদের মধু খাওয়ার আগে অবশ্যই তাদের ডাক্তারের বা ডায়েটিশিয়ানের সাথে পরামর্শ করা উচিত। তারা আপনার বর্তমান স্বাস্থ্য অবস্থা এবং রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণের উপর ভিত্তি করে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন।

“মধু স্বাস্থ্যকর” – এই ধারণাটি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সবসময় প্রযোজ্য নয়। চিনির বিকল্প হিসেবে মধু ব্যবহার করার আগে এর সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে জেনে নেওয়া জরুরি।

প্রশ্ন ৪: ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কোন বয়সে বেশি থাকে?

উত্তর: টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ঝুঁকি সাধারণত বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে থাকে। বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর এই রোগের ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়। এর কারণ হলো বয়স বাড়ার সাথে সাথে শরীরের ইনসুলিন উৎপাদন এবং ব্যবহারের ক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে। এছাড়াও, এই বয়সে জীবনযাত্রার পরিবর্তন, যেমন শারীরিক কার্যকলাপ কমে যাওয়া এবং অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, ডায়াবেটিসের ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে তোলে।

তবে, বর্তমানে একটি উদ্বেগজনক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে, তরুণ এবং এমনকি কিশোররাও টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছে। এর প্রধান কারণ হলো অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস (যেমন ফাস্ট ফুড, চিনিযুক্ত পানীয়), শারীরিক কার্যকলাপের অভাব এবং অতিরিক্ত ওজন।

সুতরাং, যদিও ৪০ বছর বয়সের পর ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে, তবে স্বাস্থ্যকর জীবনধারা অনুসরণ করে যেকোনো বয়সেই এই রোগের ঝুঁকি কমানো সম্ভব। সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ছোটবেলা থেকেই স্বাস্থ্যকর অভ্যাস গড়ে তোলা ডায়াবেটিস প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

সচেতনতা, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং নিয়মিত জীবনযাপন ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে এবং প্রতিরোধে সহায়ক। নিজের যত্ন নিন এবং সুস্থ থাকুন।


Share This Post

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

মন্তব্য করুন

আপনার ই-মেইল এ্যাড্রেস প্রকাশিত হবে না। * চিহ্নিত বিষয়গুলো আবশ্যক।